ভারতের ভূপ্রকৃতি [Physiography of India] পর্ব - ৩ [Part 3]


 

ভারতের ভূপ্রাকৃতিক বিভাগসমূহের গুরুত্ব
ভারতের ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্য দেশটির সামগ্রিক অর্থনীতি, জলবায়ু, সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রায় এক বিশাল প্রভাব ফেলে। প্রতিটি ভূপ্রাকৃতিক বিভাগেরই নিজস্ব স্বতন্ত্র গুরুত্ব রয়েছে, যা ভারতের উন্নয়নে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। পাঠ্যক্রম অনুসারে ভারতের প্রধান ভূপ্রাকৃতিক বিভাগগুলির গুরুত্ব নিচে আলোচনা করা হলো -
[০১] উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলের গুরুত্ব
ভারতের উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল, প্রধানত হিমালয় পর্বতমালা, দেশের জন্য বহু দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন -
জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ
হিমালয় পর্বতমালা একটি বিশাল প্রাচীরের মতো কাজ করে, যা মধ্য এশিয়া থেকে আসা শীতল বায়ুপ্রবাহকে ভারতে প্রবেশে বাধা দেয়। এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে তুলনামূলকভাবে উষ্ণ জলবায়ু বজায় থাকে। একইসাথে, এটি দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুকে আটকে রেখে ভারতে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করে, যা কৃষির জন্য অপরিহার্য।
নদনদীর সৃষ্টি
হিমালয় পর্বত অসংখ্য বরফগলা নদী, যেমন গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র এবং তাদের উপনদীগুলির উৎস। এই নদীগুলি সারা বছর ধরে জল সরবরাহ করে, যা উত্তর ভারতের কৃষিকাজ, পানীয় জল এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে সহায়ক।
বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ
প্রাচীনকাল থেকেই হিমালয় প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা প্রাচীর হিসেবে কাজ করেছে, যা উত্তর দিক থেকে বিদেশি আক্রমণকারীদের প্রবেশে বাধা দিয়েছে। এর দুর্গমতা দেশকে রক্ষা করতে সহায়ক হয়েছে।
পর্যটন শিল্প
হিমালয়ের মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, তুষারাবৃত শৃঙ্গ, শান্ত উপত্যকা এবং স্বাস্থ্যকর জলবায়ু এটিকে একটি প্রধান পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। দার্জিলিং, সিমলা, মানালি, নৈনিতাল, কাশ্মীর, ইত্যাদি স্থানগুলি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙা রাখে।
[০২] উত্তরের সমভূমি অঞ্চলের গুরুত্ব
ভারতের উত্তরের সমভূমি অঞ্চল, যা ইন্দো-গাঙ্গেয়-ব্রহ্মপুত্র সমভূমি নামে পরিচিত, দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এর প্রদান গুরুত্ব হলো -
কৃষির উন্নতি
নদীবাহিত পলিমাটি দ্বারা গঠিত এই সমভূমি অত্যন্ত উর্বর। এটি ভারতের 'শস্যভাণ্ডার' নামে পরিচিত এবং ধান, গম, পাট, আখ, ভুট্টা, তৈলবীজ ইত্যাদি ফসলের প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র। পর্যাপ্ত জল সরবরাহ এবং সমতল ভূমির কারণে এখানে কৃষিকাজ অত্যন্ত উন্নত।
লোকবসতি
উর্বর কৃষিজমি, জলের সহজলভ্যতা এবং সমতল ভূপ্রকৃতির কারণে এই অঞ্চলটি ভারতের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এটি গ্রামীণ ও শহুরে উভয় ধরনের জনবসতির জন্য আদর্শ।
শিল্পের উন্নতি
কৃষিপণ্যের সহজলভ্যতা এবং ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল হওয়ায় পর্যাপ্ত শ্রমিকের সরবরাহ থাকার কারণে এখানে কৃষিভিত্তিক শিল্প (যেমন চিনি, চাল, পাট শিল্প), বস্ত্র শিল্প এবং অন্যান্য অনেক শিল্প গড়ে উঠেছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
সমতল ভূপ্রকৃতির কারণে এখানে সড়কপথ, রেলপথ এবং অভ্যন্তরীণ জলপথের একটি সুবিন্যস্ত ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে, যা পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে অত্যন্ত সহায়ক।
[০৩] উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চলের গুরুত্ব
ভারতের উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চল, যা দেশের বৃহত্তম ভূপ্রাকৃতিক বিভাগ, বহু দিক থেকে মূল্যবান।
বনজ সম্পদ
মালভূমি অঞ্চলের অনেক অংশই ঘন বনভূমিতে আবৃত, যা কাঠ, মধু, ঔষধী উদ্ভিদ এবং অন্যান্য বনজ সম্পদের উৎস। এই বনভূমিগুলি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
খনিজ সম্পদ ও শিল্পোন্নতি
এই অঞ্চলটি খনিজ সম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। লোহা, কয়লা, ম্যাঙ্গানিজ, বক্সাইট, অভ্র, চুনাপাথর ইত্যাদি খনিজ পদার্থ এখানে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এই খনিজগুলির সহজলভ্যতার কারণে ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে লৌহ-ইস্পাত শিল্প, অ্যালুমিনিয়াম শিল্প এবং অন্যান্য খনিজভিত্তিক শিল্পগুলি ব্যাপকভাবে গড়ে উঠেছে, যা দেশের শিল্পোন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা ও লোকবসতি
যদিও এটি কিছুটা বন্ধুর ভূপ্রকৃতির, তবুও এখানে সড়ক ও রেলপথের মাধ্যমে বিভিন্ন খনিজ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি একে অপরের সাথে যুক্ত। খনিজ সম্পদ এবং শিল্পক্ষেত্রের বিকাশের কারণে এখানে সীমিত আকারে হলেও লোকবসতি গড়ে উঠেছে, বিশেষ করে খনিজ সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলিতে।
[০৪] উপকূলীয় সমভূমির গুরুত্ব
ভারতের দীর্ঘ উপকূলীয় সমভূমি অঞ্চল দেশটির সামুদ্রিক অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। যেমন -
যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বন্দরের গঠন
এই সমভূমি অঞ্চলটি ভারতের জন্য অসংখ্য প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় এবং বন্দরের সৃষ্টি করেছে, যা দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পরিবহনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুম্বাই, চেন্নাই, কলকাতা, বিশাখাপত্তনম, কান্দালা, কোচি ইত্যাদি প্রধান বন্দরগুলি এই উপকূল বরাবরই অবস্থিত।
মৎস্য আহরণ
সমুদ্রের কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় উপকূলীয় সমভূমি এবং সংলগ্ন সামুদ্রিক অঞ্চলগুলি মৎস্য আহরণের প্রধান কেন্দ্র। এটি লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা নির্বাহের উৎস এবং দেশের খাদ্য সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কৃষি ও শিল্পের উন্নতি
পূর্ব উপকূলের পলিগঠিত উর্বর মাটি এবং পশ্চিম উপকূলের কিছু অংশে নারকেল, মশলা ও কাজুবাদামের মতো ফসল চাষ হয়। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণ শিল্প, জাহাজ নির্মাণ এবং পর্যটন শিল্পও গড়ে উঠেছে।
[০৫] দ্বীপপুঞ্জের গুরুত্ব
ভারতের দ্বীপপুঞ্জগুলি, বিশেষ করে আন্দামান ও নিকোবর এবং লাক্ষাদ্বীপ, তাদের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেমন -
কৃষির উন্নতি
আন্দামান ও নিকোবরে রাবার, নারকেল, মশলা এবং লাক্ষাদ্বীপে নারকেল প্রধান কৃষিপণ্য। এখানকার স্থানীয় অর্থনীতিতে এই কৃষিজ পণ্যগুলির অবদান রয়েছে।
মৎস্য সংগ্রহ
দ্বীপগুলির চারপাশের সমুদ্র গভীর এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ, যা মৎস্য আহরণের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এটি স্থানীয় জনগণের জীবিকা এবং খাদ্য সরবরাহে সহায়ক।
লোকবসতি
যদিও দ্বীপগুলির লোকবসতি তুলনামূলকভাবে কম, তবুও এখানে বসবাসকারী সম্প্রদায়গুলি তাদের ঐতিহ্যবাহী জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি বজায় রাখে।
পর্যটন শিল্প
আন্দামান ও নিকোবরের সবুজ অরণ্য, আদিম সৈকত, প্রবাল প্রাচীর এবং লাক্ষাদ্বীপের স্ফটিক স্বচ্ছ নীল জল ও প্রবালগঠিত দ্বীপগুলি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। পর্যটন শিল্প এখানকার স্থানীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি।
কৌশলগত গুরুত্ব
এই দ্বীপপুঞ্জগুলি ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে এদের ভূমিকা রয়েছে।
 

Previous
Next Post »