.png)
হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকাঃ একটি সামগ্রিক আলোচনা
ভূমিকা
হিন্দু প্যাট্রিয়ট ছিল উনিশ শতকের বাংলার ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাপ্তাহিক পত্রিকা (ইংরেজি ভাষায়)। এই পত্রিকাটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। এর নির্ভীক সাংবাদিকতা এবং স্পষ্টবাদী মতামত এটিকে সমসাময়িক সমাজে একটি শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
পত্রিকার প্রকাশ ও সম্পাদক
১৮৫৩ সালের ৬ জানুয়ারি মধুসূদন রায় কর্তৃক এই পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। যদিও এর প্রতিষ্ঠাতা মধুসূদন রায় ছিলেন, তবে হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৮৫৩-১৮৬১) এর সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর পত্রিকাটি এক নতুন মাত্রা পায়। হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সাহসী সম্পাদনার ফলে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তীকালে, কৃষ্ণদাস পাল (১৮৬১-১৮৮৪) এর সম্পাদনায় পত্রিকাটি আরও শক্তিশালী হয় এবং দীর্ঘকাল ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পত্রিকার উদ্দেশ্য
হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের স্বার্থ রক্ষা করা এবং ব্রিটিশ শাসনের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা। এর প্রধান উদ্দেশ্যগুলি নিম্নলিখিতভাবে লিপিবদ্ধ করা যায়।
[ক] সামাজিক সংস্কার
পত্রিকাটি বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, সতীদাহ প্রথা এবং অস্পৃশ্যতার মতো সামাজিক কুসংস্কারগুলির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। এটি নারী শিক্ষার প্রসার এবং বিধবা বিবাহের সমর্থনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
[খ] নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন
ব্রিটিশ নীলকরদের দ্বারা ভারতীয় কৃষকদের উপর অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে পত্রিকাটি তীব্র প্রতিবাদ জানায়। নীলচাষীদের দুর্দশা এবং নীল বিদ্রোহের খবর বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করে পত্রিকাটি জনমত গঠনে সহায়তা করে।
[গ] সিপাহী বিদ্রোহ সমর্থন
এই পত্রিকা সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭) কে যদিও সরাসরি সমর্থন করেনি, তবে বিদ্রোহ দমনের নামে ব্রিটিশ সরকারের চরম দমন নীতির তীব্র নিন্দা করেছিল। এটি বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতিশীল না হলেও, তাদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের নৃশংস আচরণের সমালোচনা করেছিল।
[ঘ] সাঁওতাল বিদ্রোহ সমর্থন
১৮৫৫-৫৬ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় পত্রিকাটি সাঁওতালদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের দমনমূলক নীতির বিরোধিতা করে। সাঁওতালদের ন্যায়সঙ্গত দাবি এবং তাদের উপর হওয়া অত্যাচারের কথা পত্রিকাটি তুলে ধরেছিল।
[ঙ] জমিদারদের অত্যাচারের বিরোধিতা
ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু জমিদার যে প্রজাদের উপর অত্যাচার করত, সে বিষয়েও পত্রিকাটি সোচ্চার ছিল। এটি জমিদারদের অতিরিক্ত কর আদায় এবং প্রজাদের শোষণের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক নিবন্ধ প্রকাশ করত।
অবদান ও মূল্যায়ন / গুরুত্ব
হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা ভারতীয় সমাজে এবং রাজনীতিতে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। এর প্রধান অবদানগুলি নিম্নরূপ:
[ক] নীল চাষীদের সমর্থন
নীল বিদ্রোহের সময় পত্রিকাটি নীল চাষীদের প্রতি অবিচল সমর্থন জানায়। হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় "নীল দর্পণ" নাটকের সমর্থনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং নীল চাষীদের দুর্দশা ব্রিটিশ সরকারের নজরে আনেন।
[খ] নীলকর বিরোধী মনোভাব
পত্রিকাটি ধারাবাহিকভাবে নীলকরদের অন্যায় ও অত্যাচারী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর ফলে নীলকরদের শোষণমূলক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত তৈরি হয়।
[গ] সামাজিক সংস্কার
নারীশিক্ষা, বিধবা বিবাহ প্রচলন এবং কুসংস্কার দূরীকরণে পত্রিকাটি অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। এটি একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল সমাজ গঠনে সহায়ক হয়েছিল।
[ঘ] সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরোধিতা
পত্রিকাটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণমূলক নীতির বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রতিবাদ জানায়। এটি ভারতের সম্পদ লুণ্ঠন এবং ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের সমালোচনা করত।
[ঙ] সাঁওতাল বিদ্রোহ সমর্থন
পত্রিকাটি সাঁওতালদের অধিকারের প্রতি সংবেদনশীল ছিল এবং তাদের উপর ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিবাদ জানায়। এটি দেখিয়েছিল যে পত্রিকাটি কেবল অভিজাত শ্রেণীর নয়, বরং সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার প্রতিও সহানুভূতিশীল ছিল।
[চ] জমিদারদের অত্যাচারের বিরোধিতা
পত্রিকাটি জমিদারদের শোষণমূলক নীতির সমালোচনা করে দরিদ্র কৃষকদের পক্ষ নেয়। এটি জমিদারদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সহায়তা করে।
[ছ] সিপাহী বিদ্রোহের দমননীতির বিরোধিতা
সিপাহী বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ সরকারের চরম দমন-পীড়ন এবং নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে পত্রিকাটি প্রতিবাদ জানায়। যদিও বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি, তবে অমানবিক দমননীতির বিরোধিতা করে পত্রিকাটি মানবিকতার পরিচয় দিয়েছিল।
[জ] ইলবার্ট বিল সমর্থন [১৮৮৩]
১৮৮৩ সালের ইলবার্ট বিলের সময় পত্রিকাটি এই বিলের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়। এই বিল ভারতীয় বিচারকদের ইউরোপীয়দের বিচার করার ক্ষমতা দিয়েছিল, যা বর্ণবৈষম্য দূরীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল।
[ঝ] দেশীয় সংবাদপত্র আইনের বিরোধিতা [১৮৭৮]
১৮৭৮ সালের দেশীয় সংবাদপত্র আইন (Vernacular Press Act) এর তীব্র বিরোধিতা করে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা। এই আইন ভারতীয় সংবাদপত্রগুলির বাক স্বাধীনতা হরণ করত, যার বিরুদ্ধে পত্রিকাটি তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করে।
উপসংহারে বলা যায়, হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা কেবল একটি সংবাদপত্র ছিল না, এটি ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষে এবং ভারতীয়দের অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এর সাহসী ভূমিকা এবং নির্ভীক সাংবাদিকতা ভারতীয় সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে।