ভারতের ভূপ্রকৃতি [Physiography of India] পর্ব ২ [Part 2]

 ৩. উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চল [The Peninsular Plateau]

৪. উপকূলীয় সমভূমি অঞ্চল [The Coastal Plains]

৫. দ্বীপপুঞ্জ [Islands]

ভারতের উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চল
ভারতের উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চলটি দেশের বৃহত্তম ও প্রাচীনতম ভূ-প্রাকৃতিক বিভাগ। এটি আগ্নেয় শিলা দ্বারা গঠিত একটি টেবিল ল্যান্ড বা মালভূমি, যা প্রাচীন গন্ডোয়ানাল্যান্ডের অংশ ছিল। এর ভূতাত্ত্বিক স্থিতিশীলতা এবং খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধি এটিকে ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করেছে।
অবস্থান ও বিস্তার
উপদ্বীপীয় মালভূমি অঞ্চলটি ভারতের প্রায় 13.5 লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এর উত্তরে গঙ্গা সমভূমি, পশ্চিমে আরাবল্লী পর্বতমালা ও পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, পূর্বে পূর্বঘাট পর্বতমালা এবং দক্ষিণে কন্যাকুমারী পর্যন্ত এর বিস্তার। এই অঞ্চলটি ত্রিকোণাকৃতি এবং এর গড় উচ্চতা 600 থেকে 900 মিটার।
শ্রেণিবিভাগ
উপদ্বীপীয় মালভূমিকে প্রধানত দুটি বৃহৎ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা -
[ক] মধ্য ও পূর্ব ভারতের মালভূমি
এটি নর্মদা নদীর উত্তর দিকে অবস্থিত এবং এর অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলি হলো -
(i) মধ্যভারতের উচ্চভূমি
আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে এই অঞ্চলকে নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।
(a) আরাবল্লী পর্বত
এটি বিশ্বের প্রাচীনতম ভঙ্গিল পর্বতমালাগুলির মধ্যে অন্যতম, যা রাজস্থানের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে দিল্লির উত্তর-পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ গুরু শিখর (মাউন্ট আবু) [1,172 মি]।
(b) পূর্ব রাজস্থান উচ্চভূমি
এটি আরাবল্লীর পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি ঢেউ খেলানো মালভূমি অঞ্চল, যা মূলত চম্বল নদীর অববাহিকা।এই অঞ্চলের গড় উচ্চতা 200 – 500 মি।
(c) মধ্যভারতের মালভূমি
এটি মূলত মধ্যপ্রদেশের পশ্চিম ও উত্তর অংশ জুড়ে বিস্তৃত, যা বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরে অবস্থিত। এই অঞ্চলটি অতি প্রাচীয় আগ্নেয় শিলা ও পরিবর্তিত রূপান্তরিত শিলা দ্বারা গঠিত একটি তরঙ্গায়িত মালভূমি অঞ্চল। চম্বল বানস এই অঞ্চলের প্রধান নদী।
(d) বুন্দেলখন্ড মালভূমি
এটি উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের সীমান্তবর্তী একটি ক্ষয়প্রাপ্ত মালভূমি অঞ্চল, যা প্রাচীন গ্রানাইট ও নাইস শিলা দ্বারা গঠিত।
(e) মালব মালভূমি
এটি বিন্ধ্য পর্বতমালার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একটি লাভা গঠিত মালভূমি। এর ঢাল উত্তর দিকে এবং চম্বল, বেতওয়া, কালীসিন্দ-এর মতো নদীগুলি এর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
(f) রেওয়া মালভূমি
এটি বুন্দেলখন্ডের পূর্বে এবং সোন নদীর উত্তর দিকে অবস্থিত একটি অপেক্ষাকৃত উঁচু মালভূমি। লাভা দ্বারা গঠিত এই মালভূমি পশ্চিম থেকে পূর্বে তিনটি খাড়া ঢালে সিঁড়ির মতো নেমে এসেছে।
(g) বিন্ধ্য পর্বত
এটি একটি ভঙ্গিল পর্বতশ্রেণী যা নর্মদা নদীর সমান্তরালে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত এবং উত্তর ভারতকে দক্ষিণ ভারত থেকে পৃথক করে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় 1,050 কিমি এবং গড় উচ্চতা 300 মিটার। এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মানপুর [881 মি]।   
(h) নর্মদা উপত্যকা
বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতমালার মাঝখানে একটি গ্রস্ত উপত্যকা (rift valley) র মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একটি গুরুত্বপূর্ণ নদ নর্মদার প্রবাহের ফলে নর্মদা উপত্যকা সৃষ্টি হয়েছে।
(ii) পূর্ব ভারতের উচ্চভূমি
শোন নদী অববাহিকার দক্ষিণ – পূর্বে এবং মহাকাল পর্বতের পূর্বে পূর্ব ভারতের উচ্চভূমি অবস্থিত। এই অঞ্চলের ভূপ্রাকৃতিক অংশগুলি হলো -  
(a) ছোটোনাগপুর মালভূমি
এটি ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও ছত্তিশগড়ের কিছু অংশ জুড়ে বিস্তৃত একটি খনিজ সমৃদ্ধ মালভূমি। একে "ভারতের খনিজ ভাণ্ডার" বলা হয়। এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ পরেশনাথ। এখানকার গড় উচ্চতা 400 – 1000 কিমি। এই অঞ্চলে হুড্রু, জোনা, দশম রাজরাপ্পা জলপ্রপাত উল্লেখযোগ্য।
(b) বাঘেলখন্ড মালভূমি
এটি মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত একটি অপেক্ষাকৃত ছোট মালভূমি। এই অঞ্চলটি বিন্ধ্যযুগের পাললিক ও গ্রানাইট শিলা দ্বারা গঠিত।  
(c) মহানদী অববাহিকা
এটি ছত্তিশগড় ও ওড়িশায় অবস্থিত মহানদী নদীর উর্বর নিম্নভূমি। যদিও এটি অববাহিকা, কিন্তু মালভূমি অঞ্চলের মধ্যে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই অঞ্চলটি চুনাপাথর ও স্লেট বা শেল দ্বারা গঠিত।
(d) দন্ডকারণ্য ও গড়জাত পাহাড়
এটি ওড়িশা, ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার কিছু অংশ জুড়ে বিস্তৃত একটি বন্ধুর ও বনভূমি আচ্ছাদিত মালভূমি। এখানকার গড় উচ্চতা 400 – 1000 মিটার। বোনাই, কেওনঝড়, সিমলিপাল পাহাড় নিয়ে গড়জাত অঞ্চলটি গঠিত হয়েছে। অন্যদিকে ছত্রিশগড় সমভূমির দক্ষিণে বাস্তার, কোরাপুট, কালাহান্ডি জেলায় দন্ডকারণ্য অঞ্চলটি অবস্থিত। এখানে ইন্দ্রাবতী নদীর ওপর চিত্রকূট জলপ্রপাত রয়েছে।  
[খ] দাক্ষিণাত্য মালভূমি
এটি নর্মদা নদীর দক্ষিণ দিকে অবস্থিত এবং একটি বৃহৎ ত্রিকোণাকার অংশ জুড়ে বিস্তৃত। তিনদিক সমুদ্রবেষ্টিত এই উপদ্বীপীয় মালভূমির আয়তন প্রায় 7.5 লক্ষ বর্গ কিমি। এর অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলি হলো -
(a) পশ্চিমঘাট পর্বতমালা বা সহ্যাদ্রি
এটি ভারতের পশ্চিম উপকূলের সমান্তরালে বিস্তৃত একটি ভঙ্গিল স্তূপ পর্বত (fault-block mountain)। এর দৈর্ঘ্য প্রায় 1,600 কিলোমিটার। এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আনাইমুদি (আন্নামালাই পর্বতে অবস্থিত)। এর অন্যান্য শৃঙ্গগুলি হলো অগস্ত্যকূটম, কলসুবাই, মহাবালেশ্বর, নীলগিরি, দোদাবেদা। নাসিকের কাছে থলঘাট ও পুনের কাছে ভোরঘাট এই পর্বতের দুটি প্রধান গিরিপথ। এটি অসংখ্য নদীর (যেমন গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী) উৎসস্থল।
(b) পূর্বঘাট পর্বতমালা বা মলয়াদ্রি
এটি ভারতের পূর্ব উপকূলের সমান্তরালে বিস্তৃত একটি ক্ষয়প্রাপ্ত ভঙ্গিল পর্বতমালা। এটি পশ্চিমঘাটের মতো অবিচ্ছিন্ন নয় এবং মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন। এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জিন্দাগাড়া [1,699 মি] (অন্ধ্রপ্রদেশে)। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গগুলি হলো পলকোন্ডা, পচামালাই ইত্যাদি।  
(c) সাতপুরা পর্বত
এটি নর্মদা ও তাপ্তি নদীর মাঝে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত একটি স্তূপ পর্বতমালা। এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ধূপগড় [1,350 মি] পাঁচমারির কাছে অবস্থিত।
(d) মহারাষ্ট্র মালভূমি
এটি মূলত লাভা দ্বারা গঠিত দাক্ষিণাত্য মালভূমির উত্তর-পশ্চিম অংশ। এখানে কৃষ্ণমৃত্তিকা বা রেগুর মাটি দেখা যায়, যা কার্পাস চাষের জন্য উপযোগী। এই অঞ্চলটি ধাপে ধাপে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঢালু হয়ে গেছে। তাই একে ডেকান ট্র্যাপ বলে।
(e) কর্ণাটক মালভূমি
এটি দাক্ষিণাত্য মালভূমির দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ। এর উচ্চতা তুলনামূলকভাবে বেশি এবং এখানে বাবাবুদন পাহাড় অবস্থিত, যা কফি চাষের জন্য বিখ্যাত। এই অঞ্চলটি গ্রানাইট ও নিস শিলা দ্বারা গঠিত। এই মালভূমির পশ্চিম দিকের অংশ মালনাদ এবং পূর্ব দিকের অংশ ময়দান নামে পরিচিত।
(f) তেলেঙ্গানা মালভূমি:
এটি দাক্ষিণাত্য মালভূমির পূর্ব অংশে অবস্থিত এবং প্রধানত গ্রানাইট শিলা দ্বারা গঠিত। সাতমালা এখানকার প্রধান পাহাড়।
পশ্চিমঘাট পর্বতমালা ও পূর্বঘাট পর্বতমালার মধ্যে পার্থক্য

বৈশিষ্ট্যের ভিত্তি

পশ্চিমঘাট পর্বতমালা (সহ্যাদ্রি)

পূর্বঘাট পর্বতমালা (মলয়াদ্রি)

[ক] উচ্চতা

গড় উচ্চতা 900 থেকে 1,600 মিটার। উচ্চতা দক্ষিণ দিকে বৃদ্ধি পায়। সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আনাইমুদি (2,695 মিটার)।

গড় উচ্চতা 600 থেকে 1,2০০ মিটার। পশ্চিমঘাটের তুলনায় কম উচ্চতাসম্পন্ন। সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জিন্দাগাড়া (1,690 মিটার)।

[খ] অবস্থান

ভারতের পশ্চিম উপকূলের সমান্তরালে অবস্থিত।

ভারতের পূর্ব উপকূলের সমান্তরালে অবস্থিত।

[গ] বিচ্ছিন্নতা

এটি একটি অবিচ্ছিন্ন পর্বতশ্রেণী। শুধুমাত্র কিছু গিরিপথ (যেমন থলঘাট, ভোরঘাট, পালঘাট) দ্বারা বিচ্ছিন্ন।

এটি একটি বিচ্ছিন্ন পর্বতশ্রেণী। মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী প্রভৃতি বড় বড় নদী দ্বারা গভীরভাবে বিচ্ছিন্ন ও ক্ষয়প্রাপ্ত।

[ঘ]

ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য

এটি একটি ভঙ্গিল স্তূপ পর্বত এবং এর পশ্চিম ঢাল খাড়া ও পূর্ব ঢাল মৃদু। এখানকার পশ্চিম ঢালে জলপ্রপাত দেখা যায়।

এটি একটি ক্ষয়প্রাপ্ত ভঙ্গিল পর্বতমালা। এর ঢাল উভয় দিকেই মৃদু এবং এটি ক্ষয়প্রাপ্ত ঢেউ খেলানো ভূমির মতো।

[ঙ] স্বাভাবিক উদ্ভিদ ও বৃষ্টিপাত

পশ্চিম ঢালে মৌসুমী বায়ুর আরব সাগরীয় শাখার কারণে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় (200 - 300 সেমি)। ফলে এখানে চিরহরিৎ ও পর্ণমোচী বনভূমি দেখা যায়। এর পূর্ব ঢাল বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল হওয়ায় কম বৃষ্টিপাত হয়।

পূর্ব উপকূলের সমান্তরালে থাকলেও এখানে বৃষ্টিপাত তুলনামূলকভাবে কম (100 - 150 সেমি)। এটি বঙ্গোপসাগর থেকে আসা মৌসুমী বায়ুর সমান্তরালে থাকায় তেমন বাধা দেয় না। এখানে শুষ্ক পর্ণমোচী ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ দেখা যায়।


ভারতের উপকূলীয় সমভূমি অঞ্চল
ভারতের উপকূলীয় সমভূমি অঞ্চল উপদ্বীপীয় মালভূমির পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত একটি সংকীর্ণ সমভূমি অঞ্চল, যা বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের তীর বরাবর বিস্তৃত। এই অঞ্চলটি দেশের সামুদ্রিক বাণিজ্য, মৎস্যচাষ এবং কৃষিক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাঠ্যক্রম অনুসারে এই অঞ্চলের একটি বিস্তারিত বিবরণ নিচে দেওয়া হলো -
অবস্থান ও বিস্তার
ভারতের উপকূলীয় সমভূমি অঞ্চলটি উপদ্বীপীয় মালভূমির পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত বরাবর প্রায় 3,100 কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সংকীর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিস্তৃত। এটি উত্তরে কচ্ছের রণ থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারী এবং পূর্বে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পশ্চিমে গুজরাট পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সমভূমি মূলত সমুদ্রতরঙ্গ, নদী দ্বারা বাহিত পলি এবং বায়ু দ্বারা বাহিত বালির সঞ্চয়কার্যের ফলে গঠিত।
শ্রেণিবিভাগ
উৎপত্তি ও ভূপ্রাকৃতিক তারতম্য অনুসারে ভারতের উপকূলীয় সমভূমিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা -
[ক] পূর্ব উপকূলীয় সমভূমি
এই সমভূমিটি পূর্বঘাট পর্বতমালা এবং বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। এটি তুলনামূলকভাবে চওড়া ও উর্বর এবং অনেক বড় নদী যেমন মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী এই সমভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে এবং বিশাল বদ্বীপ সৃষ্টি করেছে।
এটি পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত। এর দৈর্ঘ্য প্রায় 1,500 কিমি এবং গড় প্রস্থ প্রায় 100 - 300 কিলোমিটার।
এই সমভূমি অঞ্চলকে আবার দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা -
(i) উত্তর সরকার উপকূল
এই অংশটি মহানদী বদ্বীপ থেকে কৃষ্ণা নদীর বদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অঞ্চলটি প্রায় 400 কিমি দীর্ঘ এবং 80 কিমি প্রশস্ত। এই উপকূল অঞ্চলের উত্তরাংশকে উৎকল বা ওড়িশা উপকূল এবং দক্ষিণাংশকে অন্ধ্র উপকূল বলে। নীচে এদের সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
(a) উৎকল বা ওড়িশা উপকূল
এটি মহানদী বদ্বীপ থেকে চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানকার মাটি উর্বর এবং ধান চাষের জন্য উপযোগী। চিল্কা হ্রদ ভারতের বৃহত্তম উপহ্রদ, যা এই উপকূলে অবস্থিত।
(b) অন্ধ্র উপকূল
এটি কৃষ্ণা নদীর বদ্বীপ থেকে পুলিকট হ্রদ পর্যন্ত বিস্তৃত। গোদাবরী ও কৃষ্ণা নদীর বদ্বীপ এই অঞ্চলে অবস্থিত, যা এটিকে অত্যন্ত উর্বর করেছে। এখানে কোল্লেরু হ্রদ ও পুলিকট হ্রদ দেখা যায়।
(ii) করমন্ডল উপকূল
এটি কৃষ্ণা নদীর বদ্বীপের দক্ষিণ থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি মূলত তামিলনাড়ু উপকূলে অবস্থিত। এই অঞ্চলে শীতকালে উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত হয়, যা এই উপকূলের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। চেন্নাই এই উপকূলেই অবস্থিত। এই উপকূলে থেরিস নামে একধরণের বালিয়াড়ি দেখা যায়। এই বালিয়াড়িরগুলির উচ্চতা 35 – 65 মিটার। 
[খ] পশ্চিম উপকূলীয় সমভূমি
এই সমভূমিটি পশ্চিমঘাট পর্বতমালা এবং আরব সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। এটি পূর্ব উপকূলীয় সমভূমির তুলনায় সংকীর্ণ ও বন্ধুর। এখানে দ্রুতগামী ছোট ছোট নদী প্রবাহিত হয়েছে এবং তারা মোহনায় বদ্বীপের পরিবর্তে খাড়ি (Estuary) সৃষ্টি করেছে।
এটি গুজরাটের কচ্ছ উপদ্বীপ থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত। এর গড় প্রস্থ মাত্র ৫০-৭৫ কিলোমিটার এবং দৈর্ঘ্য প্রায় 1,600 কিমি।
শ্রেণিবিভাগ
আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে এই উপকূল অঞ্চলকে নিম্নলিখিত ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায়।
(i) কচ্ছ উপদ্বীপ
এটি গুজরাটের উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত এবং একটি অগভীর উপসাগর দ্বারা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। এখানে কচ্ছের রণ (Rann of Kutch) অবস্থিত, যা একটি লবণাক্ত জলাভূমি এবং বর্ষাকালে জলে পূর্ণ থাকে। কচ্ছ শব্দটির অর্থ জলাময় ভূমি।
(ii) কাথিয়াবাড় উপদ্বীপ
এটি গুজরাটের কচ্ছের দক্ষিণে অবস্থিত একটি উঁচু ও ঢেউ খেলানো ও লাভাগঠিত উপদ্বীপ। এর কেন্দ্রে কিছু নিচু পাহাড় রয়েছে। গিরনার পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ গোরখনাথ এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।   
(iii) গুজরাট সমভূমি
এটি নর্মদা, তাপ্তি, মাহি ও সবরমতী নদীর পলি দ্বারা গঠিত একটি প্রশস্ত সমভূমি, যা গুজরাটের মূল ভূখণ্ডে অবস্থিত। এই অঞ্চলটি কৃষি ও শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
(iv) কোঙ্কন উপকূল
এটি মহারাষ্ট্র ও গোয়া রাজ্য জুড়ে বিস্তৃত। মুম্বাই থেকে গোয়া পর্যন্ত এই সংকীর্ণ সমভূমিটি বহু খাঁড়ি ও বন্দরের জন্য পরিচিত। এখানকার উপকূল রেখা খুব ঢেউ খেলানো এবং অনেক লেগুন দেখা যায়।
(v) কর্ণাটক উপকূল
এটি গোয়ার দক্ষিণ থেকে ম্যাঙ্গালোর পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি তুলনামূলকভাবে সংকীর্ণ এবং এর উপকূল রেখা কম ঢেউ খেলানো।
(vi) মালাবার উপকূল
এটি ম্যাঙ্গালোর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত। এই উপকূলটি অসংখ্য উপহ্রদ বা কয়াল (backwaters or Kayals)-এর জন্য বিখ্যাত, যেমন ভেম্বানাদ কয়াল। এই কয়ালগুলি পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়।

পূর্ব উপকূল ও পশ্চিম উপকূলের তুলনা 

বৈশিষ্ট্যের ভিত্তি

পূর্ব উপকূল

পশ্চিম উপকূল

অবস্থান

বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম উপকূল বরাবর পূর্বঘাট পর্বতমালা ও বঙ্গোপসাগরের মাঝে অবস্থিত। এটি উত্তরে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত।

আরব সাগরের পূর্ব উপকূল বরাবর পশ্চিমঘাট পর্বতমালা ও আরব সাগরের মাঝে অবস্থিত। এটি উত্তরে গুজরাটের কচ্ছ উপদ্বীপ থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত।

ভূপ্রকৃতি

এটি প্রধানত প্রশস্ত ও সমতল প্রকৃতির। এখানকার ভূপ্রকৃতি অপেক্ষাকৃত মৃদু ঢালযুক্ত। মূলত মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরীর মতো বড় নদীর দ্বারা বাহিত পলি সঞ্চয়ের ফলে গঠিত। এখানে অসংখ্য উপহ্রদ (Lagoon) ও বদ্বীপ দেখা যায়।

এটি প্রধানত সংকীর্ণ ও বন্ধুর প্রকৃতির। ভূপ্রকৃতি পশ্চিমঘাটের খাড়া ঢালের কারণে অপেক্ষাকৃত অসম। এখানে দ্রুতগামী ছোট ছোট নদী দেখা যায় যারা মোহনায় খাড়ি (Estuary) সৃষ্টি করে, বদ্বীপ নয়। কেরালা উপকূলে প্রচুর কয়াল (Kayals) বা ব্যাকওয়াটার দেখা যায়।

বিস্তৃতি

গড় বিস্তার প্রায় ১০০-১৩০ কিলোমিটার, যা পশ্চিম উপকূলের তুলনায় বেশি প্রশস্ত।

গড় বিস্তার প্রায় ৫০-৭৫ কিলোমিটার, যা পূর্ব উপকূলের তুলনায় সংকীর্ণ। বিশেষ করে কর্ণাটক ও কেরালা উপকূলে এটি অত্যন্ত সংকীর্ণ।

বদ্বীপ

এখানে মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী প্রভৃতি বড় নদীগুলির দ্বারা গঠিত অনেকগুলি সুবিশাল ও সুগঠিত বদ্বীপ দেখা যায়। যেমন – মহানদী বদ্বীপ, গোদাবরী-কৃষ্ণা বদ্বীপ, কাবেরী বদ্বীপ।

এখানে কোনো বৃহৎ বদ্বীপ নেই। দ্রুতগামী নদীগুলি সরাসরি সমুদ্রে পতিত হওয়ায় মোহনায় বদ্বীপের পরিবর্তে খাড়ি সৃষ্টি করে।

উচ্চতা ও উষ্ণতা

এর গড় উচ্চতা তুলনামূলকভাবে কম এবং এটি নিচু সমভূমি। গ্রীষ্মকালে উষ্ণতা বেশি থাকে, তবে সামুদ্রিক প্রভাবে উষ্ণতা খুব বেশি বৃদ্ধি পায় না। শীতকালে উষ্ণতা আরামদায়ক থাকে।

এর গড় উচ্চতা তুলনামূলকভাবে বেশি এবং বন্ধুর হওয়ায় স্থানভেদে উচ্চতার তারতম্য দেখা যায়। উষ্ণতা সারা বছরই আর্দ্র ও উষ্ণ থাকে, তবে দক্ষিণ অংশে উষ্ণতা কিছুটা বেশি অনুভূত হয়।

কৃষি ও পরিবহন

উর্বর পলিমাটির কারণে কৃষি অত্যন্ত উন্নত। ধান, পাট, আখ, নারকেল, বিভিন্ন ধরণের ডাল শস্য প্রধান ফসল। সড়ক ও রেলপথের মাধ্যমে পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও সুবিন্যস্ত, কারণ সমভূমি প্রশস্ত।

বন্ধুর ভূপ্রকৃতির কারণে কৃষি অপেক্ষাকৃত কম উন্নত, তবে নারকেল, মশলা (গোলমরিচ, এলাচ), কাজুবাদাম প্রভৃতি চাষ হয়। সড়ক ও রেলপথের মাধ্যমে পরিবহন ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত কম উন্নত এবং পশ্চিমঘাট পর্বতের কারণে কিছু অংশে চ্যালেঞ্জিং। এখানে খাড়া ঢালযুক্ত পথ বেশি দেখা যায়।

শিল্প

এখানে কৃষিভিত্তিক শিল্প (চালকল, পাটকল), বস্ত্রশিল্প, জাহাজ নির্মাণ শিল্প এবং পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প গড়ে উঠেছে। বৃহৎ শিল্পাঞ্চল যেমন বিশাখাপত্তনম, চেন্নাই এই উপকূলেই অবস্থিত।

এখানে মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ, পেট্রোকেমিক্যাল (গুজরাট), জাহাজ নির্মাণ এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প (বেঙ্গালুরু সংলগ্ন) উল্লেখযোগ্য। এখানকার শিল্প মূলত ছোট এবং মাঝারি আকারের। মুম্বাই, কান্দালা, কোচি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এখানে অবস্থিত।

বালিয়াড়ি

সমুদ্র উপকূল বরাবর বালিয়াড়ি দেখা গেলেও সেগুলি তুলনামূলকভাবে ছোট এবং বিচ্ছিন্ন। বৃহৎ নদী বদ্বীপগুলির প্রভাবে বালির সঞ্চয় কিছুটা কম।

গুজরাট উপকূলে এবং কিছু অংশে বৃহৎ ও অসংখ্য বালিয়াড়ি দেখা যায়, বিশেষ করে কচ্ছ ও কাথিয়াবাড় অঞ্চলে। বাতাসের গতিপথ ও শুষ্ক জলবায়ুর কারণে বালির সঞ্চয় বেশি হয়। কেরালা উপকূলে সৈকত বরাবর বালিয়াড়ি চোখে পড়ে।


ভারতের দ্বীপপুঞ্জ
ভারতের মূল ভূখণ্ড ছাড়াও বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে অসংখ্য ছোট-বড় দ্বীপ নিয়ে গঠিত দুটি প্রধান দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে। এই দ্বীপপুঞ্জগুলি তাদের অনন্য ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, জীববৈচিত্র্য এবং কৌশলগত গুরুত্বের জন্য পরিচিত। পাঠ্যক্রম অনুসারে ভারতের দ্বীপপুঞ্জ সম্পর্কে একটি বিস্তারিত বিবরণ নিচে দেওয়া হলো -
শ্রেণিবিভাগ
ভারতের দ্বীপপুঞ্জগুলিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:
[ক] বঙ্গোপসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ (আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ)
আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভারতের পূর্ব দিকে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত। এটি অসংখ্য ছোট-বড় দ্বীপ নিয়ে গঠিত, যার মধ্যে প্রায় 265 টি দ্বীপ রয়েছে। এগুলি মূলত হিমালয় পর্বতমালার নিমজ্জিত অংশের শীর্ষবিন্দু, যা সমুদ্রের ওপর ভেসে আছে। স্যাডলপিক [8,293 মি] এই অঞ্চলের উচ্চতম শৃঙ্গ। এর উত্তর-দক্ষিণ বিস্তার প্রায় 590 কিলোমিটার এবং মোট আয়তন প্রায় 8,293 কিমি।
এই দ্বীপগুলি আগ্নেয়গিরি এবং টেকটোনিক কার্যকলাপের ফলে গঠিত হয়েছে। এখানে ভারতের একমাত্র সক্রিয় আগ্নেয়গিরি (সুপ্ত) ব্যারেন দ্বীপ (Barren Island) অবস্থিত। এছাড়া এখানে নারকোন্ডাম নামে একটি মৃত আগ্নেয়গিরি আছে। এখানকার মাটি প্রধানত আগ্নেয় শিলা দ্বারা গঠিত।
[খ] আরব সাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ (লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জ)
লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জ ভারতের পশ্চিম দিকে আরব সাগরে অবস্থিত। এটি মোট 25 টি ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত, যার মধ্যে মাত্র 11 টিতে জনবসতি রয়েছে। এই দ্বীপগুলির মোট আয়তন মাত্র 32 বর্গ কিলোমিটার।
লাক্ষাদ্বীপ মূলত প্রবাল প্রাচীর (Coral Reefs) দ্বারা গঠিত। এগুলি প্রবাল কীটের কঙ্কাল জমে জমে তৈরি হয়েছে। দ্বীপগুলি খুবই নিচু এবং এদের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশি নয়। এই দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে মিনিকয়, কাবারাত্তি, আমিনদিভি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কাবারাত্তি হল লাক্ষাদ্বীপের রাজধানী।
  


Previous
Next Post »