জীবনবিজ্ঞানঃ হরমোন – বিষয়গত আলোচনা


মাধ্যমিক প্রস্তুতি 2021, Madhyamik Life Science 2021  মাধ্যমিক জীবনবিজ্ঞান Madhyamik Life Science হরমোন




হরমোন
উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহের বিশেষ কতগুলি স্থানে যে জটিল জৈব রাসায়নিক তরল পদার্থ উৎপন্ন হয়ে  উৎপত্তিস্থল থেকে অতি সূক্ষ্মমাত্রায় অন্যত্র পরিবাহিত হয়ে দেহের স্বাভাবিক ও সুসংহত বৃদ্ধি, জনন এবং নানারকম শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলী সম্পন্ন করে ও কাজের শেষে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়,  যার প্রভাব বিলম্বিত, ক্রমান্বয়িক ও সুদূরপ্রসারী, তাকে হরমোন বা উত্তেজক রস বলে।     
উদ্ভিদ হরমোনের প্রকারভেদ
উদ্ভিদ হরমোনকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা –
[ক] প্রাকৃতিক হরমোন –
উদ্ভিদদেহে যে সব হরমোন সংশ্লেষিত হয়, তাদের স্বাভাবিক হরমোন বলে। যেমন – অক্সিন, জিব্বেরেলিন, সাইটোকাইনিন ইত্যাদি।
[খ] কৃত্রিম বা সংশ্লেষিত হরমোন –
যে সব রাসায়নিক পদার্থ কৃত্রিম ভাবে রসায়নাগারে প্রস্তুত করা হয়, তাদের কৃত্রিম হরমোন বা সংশ্লেষিত হরমোন বলে। - যেমন কৃত্রিম অক্সিন, কৃত্রিম জিব্বেরেলিন ইত্যাদি।
[গ] প্রকল্পিত হরমোন –
যে সব হরমোন উদ্ভিদদেহে সংশ্লেষিত হলেও এদের রাসায়নিক গঠন ও কাজ সম্পর্কে এখনও জানা যায়নি, তাদের প্রকল্পিত হরমোন বলে। যেমন – ফ্লোরিজেন, ডরমিন ইত্যাদি।
কয়েকটি বিশেষ উদ্ভিদ হরমোন
অক্সিন
উৎস –
কান্ডের অগ্রভাগে, বীজ এবং উদ্ভিদের বর্ধনশীল পাতায় অক্সিনের পরিমাণ বেশি। মূলের অগ্রভাগেও অক্সিন খুব সামান্য পরিমাণে উৎপন্ন হয়। অঙ্কুরিত রেণুতে অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে অক্সিন সংশ্লেষিত হয়।
রাসায়নিক উপাদান –
অক্সিন এক ধরনের প্রাকৃতিক হরমোন। এতে কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন থাকে এবং এর রাসায়নিক নাম হলো ইন্ডোল অ্যাসেটিক অ্যাসিড।
ভূমিকা –
[ক] অগ্রস্থ প্রকটতা –
বিজ্ঞানী থিম্যান এবং স্কোগ ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে অক্সিনের অগ্রস্থ প্রকটতা প্রমাণ করে। অক্সিন পার্শ্ব বা কাক্ষিক মুকুলের বৃদ্ধি রোধ করে অগ্রমুকুলের বৃদ্ধি ঘটায়। এর ফলে কান্ডের সার্বিক দৈর্ঘ্যবৃদ্ধি ঘটে ও উদ্ভিদ লম্বা হয়।
[খ] কোশ বিভাজন –
অক্সিন DNA গঠনের মাধ্যমে কোশ বিভাজনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত, অক্সিনের অভাবে মাইটোসিস ব্যহত হয়।
[গ] কোশের আকার বৃদ্ধি –
অক্সিন সেলুলোজ নামক উৎসেচক বা এনজাইমের কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে কোশ প্রাচীরের নমনীয়তা বৃদ্ধি করে এবং এরই ফলশ্রুতি কোশের প্রসারণ ও আয়তন বৃদ্ধি। অক্সিন কোশ গহ্বর সৃষ্টি করেও কোশের বৃদ্ধি ঘটায়।
[ঘ] কম ঘনত্বে মূলের বৃদ্ধি –
মূলের বৃদ্ধি নির্ভর করে অক্সিনের কম ঘনত্বের ওপর। যেদিকে অক্সিনের পরিমাণ কম থাকে, সেদিকের কোশ খুব তাড়াতাড়ি বিভাজিত হয়। মূলের অগ্রভাগের নিচের দিকে অক্সিনের পরিমাণ বেশি থাকে বলে সেই অংশে কোশ বিভাজন কম হয়। কিন্তু অগ্রভাগে অক্সিনের পরিমাণ কম থাকে বলে সেখানে কোশ খুব তাড়াতাড়ি বিভাজিত হয়। তাই মূলের অগ্রভাগ আলোর বিপরীত দিকে বৃদ্ধি পায়।
[ঙ] ফলের বৃদ্ধি –
নিষেকের পর ডিম্বাশয়ে অক্সিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে ডিম্বক বীজে ও ডিম্বাশয় ফলে পরিণত হয়।
[চ] ট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণ –
বাহ্যিক উদ্দীপকের গতিপথ অনুসারে উদ্ভিদ অঙ্গের বক্রচলনকে ট্রপিক চলন বলে। এই চলনে অক্সিনের ভূমিকা নিম্নরূপ –
[০১] ফটোট্রপিক চলন –
ফটোট্রপিক চলন অক্সিন হরমোনের প্রভাবে ঘটে। উদ্ভিদের যে পাশে সূর্যের আলো পড়ে তার বিপরীত দিকে বেশিমাত্রায় অক্সিন জমা হয়। এর ফলে অন্ধকার অঞ্চলের কোশগুলি খুব তাড়াতাড়ি  বিভাজিত হওয়ায় কান্ড আলোর দিকে বেঁকে যায়।
[০২] জিওট্রপিক চলন –
জিওট্রপিক চলনও অক্সিনের অসম বন্টনের ওপর নির্ভর করে। অভিকর্ষের টানে কান্ডের অগ্রভাগের নিচে বেশি অক্সিন জমা হয়। ফলে ঐ অঞ্চলের কোশগুলি দ্রুত বিভাজিত হয় এবং কান্ডের অগ্রভাগ বর্ধিত হয়ে ওপরের দিকে উঠে যায়।
জিব্বেরেলিন
উৎস –
অঙ্কুরিত এবং বর্ধনশীল বীজে ও দ্রুত বর্ধনশীল কলাই জিব্বেরেলিন হরমোনের প্রধান উৎপত্তিস্থল। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে কর্কোরান ও ফিনি প্রমাণ করেন পরিপক্ক বীজেই অধিকাংশ জিব্বেরেলিন বর্তমান।  
রাসায়নিক গঠন –
জিব্বেরেলিন একটি নাইট্রোজেন বিহীন জৈব অম্ল। এটি প্রধানত কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন নিয়ে গঠিত। এর রাসায়নিক নাম জিব্বেরেলিক অ্যাসিড।
ভূমিকা –
[ক] মুকুল ও বীজের সুপ্তাবস্থা ভঙ্গ করা –
জিব্বেরেলিন হরমোনের একটি প্রধান কাজ মুকুল ও শস্যবীজের সুপ্তাবস্থা ভঙ্গ করা অর্থাৎ অঙ্কুরোদগমের সময় ভ্রূণকে উদ্দীপ্ত করে ভ্রূণের বৃদ্ধিকে তরান্বিত করে।
[খ] পর্বমধ্যের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি –
খর্ব বিটপযুক্ত উদ্ভিদে নিম্ন মাত্রায় জিব্বেরেলিন প্রয়োগ করলে পর্বমধ্যের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়। ফলে উদ্ভিদটি স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য সম্পন্ন হয়। বংশগত খর্বতা দূর করাই জিব্বেরেলিন হরমোনের প্রধান একটি কাজ।  
[ফ] ফলের বৃদ্ধি –
জিব্বেরেলিন হরমোন প্রয়োগ করলে আঙ্গুর, কলা প্রভৃতি ফলের আকার ও পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
সাইটোকাইনিন
উৎস –
সুমিষ্ট ভুট্টার শস্য, নারকেলের দুধ, আপেল, কলা, টম্যাটো, কড়াইশুঁটি ইত্যাদি উদ্ভিদে এই হরমোন পাওয়া যায়।
রাসায়নিক গঠন –
সাইটোকাইনিন হল ক্ষারীয় প্রকৃতির হরমোন। এটি কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন এর যৌগ।
ভূমিকা –
[ক] কোশ বিভাজন –
সাইটোকাইনিনের প্রথম ও প্রধান কাজ কোশ বিভাজনের সাইটোকাইনেসিস প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করে কোশ বিভাজন সম্পন্ন করা। কোনো কলা পুষ্টি মাধ্যম সাইটোকাইনিন ব্যতীত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না।
[খ] পার্শ্বীয় মুকুলের বৃদ্ধি –
শীর্ষমুকুলের অব্যাহত বৃদ্ধিকে প্রতিহত করতে সাইটোকাইনিনের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সাইটোকাইনিন অগ্রমুকুলের বৃদ্ধি ব্যহত করে পার্শ্বীয় বা কাক্ষিক মুকুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে।   
[গ] পত্রমোচন রোধ করা -  
সাইটোকাইনিন অপসৃত পাতার ক্লোরোফিলের ভাঙন বিলম্বিত করে। ফলে পত্রমোচন রোধ পায় ও উদ্ভিদের বার্ধক্য বিলম্বিত হয়। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী রিচমন্ড ও ল্যাং সর্বপ্রথম এই ঘটনাটি ব্যাখ্যা করেন এবং এই কারণে এটি রিচমন্ড – ল্যাং প্রতিক্রিয়া নামে পরিচিত।  
সংশ্লেষিত হরমোনের ভূমিকা –
[ক] শাখাকলম থেকে নতুন উদ্ভিদ সৃষ্টি –
গোলাপ, জবা, ডালিয়া প্রভৃতি যেসব উদ্ভিদের বীজ উৎপন্ন হয় না তাদের শাখাকলম দিয়ে বংশবিস্তারের সময় কৃত্রিম অক্সিন প্রয়োগ করলে খুব তাড়াতাড়ি অস্থানিক মূল সৃষ্টি হয়।
[খ] আগাছানাশক হিসেবে –
কৃত্রিম অক্সিন প্রয়োগ করে চাষের জমির আগাছা বিনাশ করা হয়।
[গ] বীজবিহীন ফল সৃষ্টি -  
নিষেক না ঘটিয়ে অথবা ফল সৃষ্টিতে অসুবিধা ঘটলে কৃত্রিম অক্সিন বা কৃত্রিম জিব্বেরেলিন প্রয়োগ করলে ডিম্বাশয় হরমোনের প্রভাবে ফলে পরিণত হয়। এই ফলে কোনো বীজ হয় না, যেমন – কলা, পেঁপে, আপেল, আঙ্গুর প্রভৃতি। নিষেক ছাড়াই বীজহীন ফলের উৎপত্তিকে পার্থেনোকার্পি বলে।

Previous
Next Post »