মাধ্যমিক বাংলা - আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি

 আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি

শঙ্খ ঘোষ

সারমর্ম ও প্রশ্নোত্তর


 

শঙ্খ ঘোষের লেখা “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি” কবিতাটি এক গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার প্রতিচিত্র।   

কবিতাটির আবহ এক নিঃসঙ্গ, বিপর্যস্ত পৃথিবী যেখানে সর্বত্র ধ্বংসের ছাপ। সামনে কোনো মুক্তির পথ নেই, পেছনে শুধুই অনিশ্চয়তার অন্ধকার। চারপাশের পরিবেশ ভয়ংকর — একদিকে ভূপাতিত ভূমি, অন্যদিকে অতল গিরিখাত, মাথার ওপর যুদ্ধ বিমানের কর্কশ হুঙ্কার, আর পায়ের নিচে কঠোর প্রতিবন্ধকতা। যেন চারদিক থেকে মৃত্যু এগিয়ে আসছে, সমস্ত আশ্রয় একে একে ভেঙে পড়ছে। ঘরবাড়ি উড়ে গেছে, পরিচিত পরিবেশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, এমনকি নিষ্পাপ শিশুরাও রক্ষা পায়নি এই মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে। জীবনের প্রতিটি কোণ যেন শ্মশানভূমিতে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এক নৈরাশ্যজনিত প্রশ্ন উচ্চারিত হয় — তবে কি সবাই একে একে নিঃশেষ হয়ে যাবে ? কবির নিজের ভাষায় –

আমরাও তবে এই ভাবে

এ – মুহূর্তে মরে যাব নাকি ?  

কিন্তু কবি এই সর্বগ্রাসী হতাশাকে সহজে মেনে নেন না। আশাহীনতার মাঝেও তিনি এক নতুন পথের সন্ধান করতে চান। যখন চারপাশের সমস্ত পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে, যখন ব্যক্তিগত মুক্তির আর কোনো উপায় নেই, তখন একমাত্র অবলম্বন হতে পারে পারস্পরিক বন্ধন। এই বন্ধনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অস্তিত্ব রক্ষার চাবিকাঠি। ইতিহাসের পরিণতি কী হবে, তা হয়তো অনিশ্চিত, হয়তো মানুষের নিজস্ব কোনো ইতিহাস নেই, আবার হয়তো মানুষ নিজেরাই এখন ইতিহাস হয়ে উঠেছে। পরিচয়হীনতার এই শূন্যতায় মানুষ যেন নিঃস্ব পথিক, চোখ-মুখ ঢাকা, সারাবছর বঞ্চনার শিকার। দারিদ্র্য ও অপমান তাদের নিত্যসঙ্গী, তাদের কথা  কেউ শোনে না, তাদের কান্না কোথাও পৌঁছায় না।  

এই অনিশ্চয়তা ক্রমেই বৃহত্তর মাত্রা লাভ করে। পৃথিবী কি সত্যিই এখনো টিকে আছে, নাকি সেটিও নিঃশেষ হয়ে গেছে ? পৃথিবীর শ্বাস কি এখনো সচল, নাকি সে-ও ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে ? মানুষের দুর্দশা, তার যন্ত্রণা কেউ বোঝে না, তার কোনো মূল্য নেই, ফলে মানুষের নিঃসঙ্গ পরিভ্রমণ অব্যাহত থাকে—দরজায় দরজায়, যেন নিঃস্বতায় ভরা এক অন্তহীন যাত্রা।   

তবু সম্পূর্ণ ধ্বংসের আগেও যদি কিছু মানুষ টিকে থাকে, তবে সেই ক্ষীণ সংখ্যার মধ্যেই নিহিত থাকতে পারে সম্ভাবনার আলো। একাকী বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানেই সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাওয়া, কিন্তু যদি পরস্পরকে আঁকড়ে ধরা যায়, তবে হয়তো টিকে থাকার একটি পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কবি দৃঢ় প্রত্যয়ে আহ্বান জানান — আসো, একে অপরের হাত ধরে থাকি, একসঙ্গে থাকি, আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হই। এই একতার শক্তিতেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতে বেঁচে সম্ভাবনা। সমস্ত পথ যখন বন্ধ, সমস্ত আশ্রয় যখন হারিয়ে গেছে, তখন আমাদের নিজেদেরই আশ্রয় হতে হবে একে অপরের জন্য। বিচ্ছিন্নতার চেয়ে সংহতির শক্তি হাজার গুণ বেশি। একত্রিত থাকলেই হয়তো একদিন মুক্তির নতুন পথ দেখা যাবে।

Newest
Previous
Next Post »