প্রকাশনার সময় ও উদ্যোক্তা
"বামাবোধিনী পত্রিকা" ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নারীকেন্দ্রিক পত্রিকা। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৬৩ সালের ১৮ এপ্রিল। এই পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন কেশবচন্দ্র সেনের অনুগামী তথা ব্রাহ্ম আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য নেতৃত্ব উমেশচন্দ্র দত্ত।
প্রথম সম্পাদক
বামাবোধিনী পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন উমেশচন্দ্র দত্ত।
নারীসমাজের উন্নয়নে বামাবোধিনী পত্রিকার অবদান
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সমাজে নারীশিক্ষা ও নারীদের অধিকার নিয়ে
প্রচুর বিতর্ক ছিল। সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার ও নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে
বামাবোধিনী পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এর অবদান নিম্নলিখিতভাবে তুলে
ধরা যায়—
[০১] নারীশিক্ষার প্রসার
· - পত্রিকাটি
নারীদের শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করতো।
· - মেয়েদের
শিক্ষার বিরুদ্ধে প্রচলিত কুসংস্কারের মোকাবিলা করতো।
· - শিক্ষিত
নারীরা সমাজে কীভাবে অবদান রাখতে পারেন, সে সম্পর্কে আলোকপাত করতো।
[০২]
সমাজসংস্কার ও নারীর অধিকার
· - বিধবা
বিবাহ, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রথার বিরোধিতা করা হতো।
· - নারীজীবনের
উন্নতি ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির আহ্বান জানানো হতো।
·
সমাজের
প্রচলিত কুসংস্কার দূর করার চেষ্টা করা হতো।
[০৩] নারীদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলা
· - নারীদের
আত্মবিশ্বাস বাড়ানো এবং কর্মজীবনে প্রবেশের পথ প্রশস্ত করা ছিল এর অন্যতম লক্ষ্য।
· - গৃহবন্দি
নারীদের সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হতো।
[০৪] সমাজের উচ্চশ্রেণির নারীদের মধ্যে সচেতনতা
সৃষ্টি:
· - বিশেষ
করে শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত নারীদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করা হতো।
· - শিক্ষিত
নারীদের সমাজসেবামূলক কাজে উৎসাহিত করা হতো।
সমকালীন সমাজের চিত্র
১৮৬০-এর দশকে বাংলার সমাজ এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য
দিয়ে যাচ্ছিল। এই পত্রিকা থেকে সে সময়কার সমাজের যে চিত্র পাওয়া যায় তা হলো—
[০১] নারীশিক্ষার প্রতি বিরোধিতা:
সমাজের একটি বড় অংশ মনে করত নারীশিক্ষা অবাঞ্ছিত এবং এটি পরিবার
ও সংস্কৃতি ধ্বংস করবে।
[০২] নারীদের অধিকার হরণ:
মেয়েদের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার ছিল না, এবং তাদের শিক্ষা
ও বিবাহবিষয়ক সিদ্ধান্ত পুরুষরাই নিতেন।
[০৩] বিধবা নারীদের দুর্দশা:
বিধবা বিবাহ বিরোধিতা ছিল প্রবল। বিধবা নারীদের প্রতি সামাজিক
অবজ্ঞা ও কষ্টকর জীবনযাপনের চিত্র উঠে আসে।
[০৪] পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা:
নারীকে শুধু গৃহস্থালির কাজে সীমাবদ্ধ রাখার প্রবণতা বিদ্যমান
ছিল। নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহের মতো নির্মম সামাজিক রীতিনীতি
গ্রহণে বাধ্য করা হতো।
[০৫] ব্রাহ্ম সমাজ ও নবজাগরণ:
এই পত্রিকা থেকে জানা যায়, সমকালীন সমাজে ব্রাহ্ম সমাজ ও অন্যান্য
সমাজসংস্কারকরা নারীশিক্ষার প্রসার ও সামাজিক পরিবর্তনের চেষ্টা করছিলেন।
বামাবোধিনী পত্রিকার সীমাবদ্ধতা
যদিও বামাবোধিনী পত্রিকা নারীদের জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রেখেছিল, তবে কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল—
[০১] সমাজের সর্বস্তরের নারীদের অন্তর্ভুক্ত
করতে ব্যর্থতা:
· - এটি
মূলত উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত নারীদের কথা বলত।
· - নিম্নবিত্ত
বা গ্রামাঞ্চলের নারীদের সমস্যা নিয়ে কম আলোচনা করা হত।
[০২] শুধুমাত্র ব্রাহ্ম সমাজের ভাবধারা প্রতিফলিত:
· - পত্রিকাটি
মূলত ব্রাহ্ম সমাজের সংস্কারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরিচালিত ছিল।
· - অন্যান্য
সম্প্রদায়ের নারীদের বাস্তব পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ব পেত।
[০৩] কর্মজীবী নারীদের প্রসঙ্গে সীমিত আলোচনা:
·
যদিও
আত্মনির্ভরশীলতার ওপর জোর দেওয়া হত, তবুও কর্মজীবী নারীদের জন্য আলাদা করে স্পষ্ট
দিকনির্দেশনা ছিল না।
[০৪] নারীদের শুধুমাত্র গৃহকেন্দ্রিক উন্নতির
ওপর গুরুত্ব:
· - অধিকাংশ
ক্ষেত্রে নারীদের ঘরের মধ্যে থেকে কিভাবে উন্নতি করা যায় সে বিষয়েই আলোচনা করা হত।
· - রাজনৈতিক
বা সামাজিক আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় ভূমিকার কথা খুব বেশি আলোচিত হত না।
উপসংহার
বামাবোধিনী পত্রিকা নারীদের শিক্ষা, অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা
বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এটি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় নারীজাগরণের
পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছিল। যদিও এর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, তবে এই পত্রিকার মাধ্যমে
নারীরা প্রথমবারের মতো নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হতে পেরেছিলেন এবং ধীরে ধীরে
সামাজিক পরিবর্তনের পথে এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন।
x