পৃথিবীর চাপবলয়সমূহ ও নিয়ত বায়ুপ্রবাহ





বায়ুর চাপবলয় ও বায়ুপ্রবাহঃ

উপএককঃ পৃথিবীর চাপবলয়সমূহ ও নিয়ত বায়ুপ্রবাহ

পৃথিবীর বায়ুচাপ বলয়ঃ

পৃথিবীতে বায়ুর চাপের ক্ষেত্রে দুটি অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। যথা – [ক] উচ্চচাপ ও [খ] নিম্নচাপ।

কোনো স্থানে বায়ুর চাপ যদি তার পার্শ্ববর্তী এলাকার বায়ুর চাপের থেকে বেশি হয়, তবে সেই স্থানের বায়ুর চাপকে উচ্চচাপ বলে। একইভাবে, কোনো স্থানের বায়ুর চাপ যদি তার পার্শ্ববর্তী এলাকার বায়ুর চাপের থেকে কম হয়, তবে সেই স্থানের বায়ুর চাপকে নিম্নচাপ বলে।  

বায়ুচাপের তারতম্য অনুসারে পৃথিবীকে সাতটি নির্দিষ্ট বায়ুচাপ অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। পৃথিবীর আকৃতি গোলাকার হওয়ায় এক – একটি বায়ুচাপ অঞ্চল পৃথিবী পৃষ্ঠকে এক একটি বলয়ের মতো ঘিরে আছে। তাই এদের চাপবলয়ও বলে। এই সাতটি বায়ুচাপ বলয়ের মধ্যে চারটি স্থায়ী উচ্চচাপ বলয় এবং চারটি স্থায়ী নিম্নচাপ বলয়। নীচে এই বলয়গুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো –

[০১] নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ঃ

নিরক্ষরেখার উভয় পাশে 10o  অক্ষাংশের মধ্যে এই চাপবলয়টি দেখা যায়।

এই অঞ্চলে সূর্য সারাবছর লম্বভাবে কিরণ দেয়। ফলে এখানকার বায়ু উষ্ণ ও হালকা হয়। পাশাপাশি, নিরক্ষীয় অঞ্চলে স্থলভাগের তুলনায় জলভাগের পরিমাণ বেশি হওয়ায়, সূর্যের তাপে প্রচুর পরিমাণে জল বাষ্পে পরিণত হয়ে এখানকার বাতাসে মিশে থাকে। জলীয় বাষ্প পূর্ণ বায়ু শুষ্ক বায়ুর চেয়ে হালকা হয়। ফলে নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণে উষ্ণ ও হালকা বায়ু ওপরে উঠে যায় এবং এই অঞ্চলে একটি স্থায়ী নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়।

এই বায়ু প্রধানত ঊর্ধ্বগামী বলে এর অনুভূমিক প্রবাহ নেই বললেই চলে। ফলে এখানে একটি শান্তভাব বিরাজ করে। তাই এই অঞ্চলকে নিরক্ষীয় শান্ত বলয় বলে।

[০২] ও [০৩] কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চচাপ বলয়ঃ

       নিরক্ষীয় অঞ্চলের উষ্ণ, আর্দ্র ও হালকা বায়ু ওপরের দিকে উঠে পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্য উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ছড়িয়ে যায়। সেখানে ক্রমশ শীতল ও ভারী হয়ে দুই ক্রান্তীয় অঞ্চলে (25o – 30o অক্ষাংশ) নেমে আসে।

       আবার মেরুপ্রদেশ থেকে শীতল ও ভারী বায়ু নিরক্ষরেখার দিকে অগ্রসর হয়। ফলে কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি সংলগ্ন এলাকায় বায়ুর চাপ খুব বেশি হয়। ফলে এখানে একটি স্থায়ী উচ্চচাপ বলয় সৃষ্টি হয়।

       এই বায়ুর গতি প্রধানত নিম্নমুখী। তাই এখানেও একটি শান্তভাব বিরাজ করে।

       এই অঞ্চলে ওপর থেকে শীতল ও ভারী বায়ু উষ্ণতর ভূপৃষ্ঠে নেমে আসে বলে এখানকার বায়ু শুকনো হয়। তাই, সাহারা বা কালাহারির মতো বড়ো বড়ো মরুভূমিগুলি এই অঞ্চলে অবস্থিত।

[০৪] ও [০৫] মেরুপ্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয় [সুমেরু বৃত্ত ও কুমেরু বৃত্ত নিম্নচাপ বলয়]  

       পৃথিবীর আবর্তন বেগ মেরুদ্বয়ের তুলনায় মেরুবৃত্ত প্রদেশে [60o – 65o অক্ষাংশ) খুব বেশি হয়। ফলে এখানকার বায়ু ক্রান্তীয় অঞ্চলের দিকে বিক্ষিপ্ত হয় ও বায়ুর চাপ হ্রাস পায়। ফলে এখানে একটি স্থায়ী নিম্নচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়।

[৬] ও [৭] মেরুদেশীয় উচ্চচাপ বল্য [সুমেরু ও কুমেরু উচ্চচাপ বলয়]     

       দুই মেরু সংলগ্ন অঞ্চলে অধিক শৈত্যের জন্য বায়ু সবসময় শীতল ও ভারী হয়। পাশাপাশি সূর্যকিরণের অভাবে এখানকার বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম হয়। তাই এখানে স্থায়ী উচ্চচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

বায়ুপ্রবাহঃ

ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে বা অনুভূমিক দিকে উচ্চচাপ অঞ্চল থে নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে বায়ু চলাচলকে বায়ুপ্রবাহ বলে। বায়ুচাপ অঞ্চলদুটির মধ্যে বায়ুপ্রবাহের পার্থক্যের ওপর বায়ুপ্রবাহের গতিবেগ নির্ভর করে। তাই দেখা যায়, বায়ু কখনও প্রবল বেগে আবার কখনও ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়।

বায়ু সবসময় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রবাহিত হয়। এই প্রবাহ কিছু নিয়ম অনুসরণ করে। যেমন –

[ক] সাধারণত উচ্চচাপ বলয় থেকে শীতল ও ভারী বায়ু নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হয়।

[খ] বায়ু প্রবাহিত হওয়ার সময় উত্তরগোলার্ধের ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধের বামদিকে বেঁকে যায়। এই নিয়মটিকে ফেরেলের সূত্র বলে।

বায়ুপ্রবাহের প্রকারভেদঃ

বায়ুপ্রবাহের উৎপত্তি, গতিপ্রকৃতি এবং বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে একে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলি হলো –

[ক] নিয়ত বায়ুপ্রবাহ  

[খ] সাময়িক বায়ুপ্রবাহ  

[গ] স্থানীয় বায়ুপ্রবাহ  

[ঘ] আকস্মিক বায়ুপ্রবাহ

নীচে বিভিন্ন প্রকারের বায়ুপ্রবাহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

[ক] নিয়ত বায়ুপ্রবাহঃ  

পৃথিবীর বায়ুচাপ বলয়গুলির তারতম্যের কারণে যে বায়ু সারাবছর ধরে নিয়মিতভাবে একটি নির্দিষ্ট পথে নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত হয়, তাকে নিয়ত বায়ু বলে।

নিয়ত বায়ুকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা – আয়ন বায়ু, পশ্চিমা বায়ু ও মেরু বায়ু।

আয়ন বায়ু     

ক্রান্তীয় উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে সারাবছর ধরে নিয়মিতভাবে এবং নির্দিষ্ট পথে যে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাকে আয়ন বায়ু বলে।

নিরক্ষীয় অঞ্চলে সূর্য সারাবছর লম্বভাবে কিরণ দেয়। ফলে এখানকার বায়ু উষ্ণ ও হালকা হয়। পাশাপাশি, এই অঞ্চলে স্থলভাগের তুলনায় জলভাগের পরিমাণ বেশি হওয়ায়,  সূর্যের তাপে প্রচুর পরিমাণে জল বাষ্পে পরিণত হয়ে এখানকার বাতাসে মিশে থাকে। ফলে নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে প্রচুর পরিমাণে উষ্ণ ও হালকা বায়ু ওপরে উঠে যায় এবং এই অঞ্চলে একটি স্থায়ী নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়।

পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্য এই ঊর্ধ্বমুখী বায়ু উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ছড়িয়ে যায়। সেখানে ক্রমশ শীতল ও ভারী হয়ে দুই ক্রান্তীয় অঞ্চলে (25o – 30o অক্ষাংশ) নেমে আসে। আবার মেরুপ্রদেশ থেকে শীতল ও ভারী বায়ু নিরক্ষরেখার দিকে অগ্রসর হয়। ফলে কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি সংলগ্ন এলাকায় বায়ুর চাপ খুব বেশি হয়। ফলে এখানে একটি স্থায়ী উচ্চচাপ বলয় সৃষ্টি হয়। এই উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে আয়নবায়ু প্রবাহিত হয়।

ফেরেলের সূত্র অনুসারে উত্তর গোলার্ধে উত্তর – পূর্ব দিক থেকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে এই বায়ু প্রবাহিত হয়।

উত্তর গোলার্ধের আয়ন বায়ুকে উত্তর – পূর্ব আয়ন বায়ু এবং দক্ষিণ গোলার্ধের আয়ন বায়ুকে দক্ষিণ – পূর্ব আয়ন বায়ু বলে।

প্রাচীনকালে বাণিজ্য জাহাজগুলি এই বায়ুকে অনুসরণ করত বলে, একে বাণিজ্য বায়ু বলে।

সাধারণত উচ্চচাপ অঞ্চল দিয়ে এই বায়ু প্রবাহিত হয় বলে এইসব স্থানে আবহাওয়া উষ্ণ, শুষ্ক ও মেঘমুক্ত প্রকৃতির হয়। সাহারা বা কালাহারির মতো বড়ো বড়ো মরুভূমিতে এই বায়ুপ্রবাহের প্রভাব দেখা যায়।

পশ্চিমা বায়ু

ক্রান্তীয় উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে মেরুপ্রদেশীয় নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে সারাবছর ধরে নিয়মিতভাবে এবং নির্দিষ্ট পথে যে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাকে পশ্চিমা বায়ু বলে।

নিরক্ষীয় নিম্নচাপ অঞ্চল থেকে ঊর্ধ্বগামী শীতল ও হালকা বায়ু পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্য উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ছড়িয়ে যায়। সেখানে ক্রমশ শীতল ও ভারী হয়ে দুই ক্রান্তীয় অঞ্চলে (25o – 30o অক্ষাংশ) নেমে আসে। আবার মেরুপ্রদেশ থেকে শীতল ও ভারী বায়ু নিরক্ষরেখার দিকে অগ্রসর হয়। ফলে কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি সংলগ্ন এলাকায় বায়ুর চাপ খুব বেশি হয়। ফলে এখানে একটি স্থায়ী উচ্চচাপ বলয় সৃষ্টি হয়।

অন্যদিকে পৃথিবীর আবর্তন বেগ মেরুদ্বয়ের তুলনায় মেরুবৃত্ত প্রদেশে [60o – 65o অক্ষাংশ) খুব বেশি হয়। ফলে এখানকার বায়ু ক্রান্তীয় অঞ্চলের দিকে বিক্ষিপ্ত হয় ও বায়ুর চাপ হ্রাস পায়। ফলে এখানে একটি স্থায়ী নিম্নচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়। এর ফলে ক্রান্তীয় উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে মেরু প্রদেশীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে এক ধরনের বায়ু ধারাবাহিকভাবে প্রবাহিত হয়। একেই পশ্চিমা বায়ু বলে।

ফেরেলের সূত্র অনুসারে উত্তর গোলার্ধে দক্ষিণ পশ্চিম থেকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে উত্তর পশ্চিম দিক থেকে এই বায়ু প্রবাহিত হয়।

উত্তর গোলার্ধের মৌসুমী বায়ুকে দক্ষিণ পশ্চিম পশ্চিমা বায়ু এবং দক্ষিণ গোলার্ধের পশ্চিমা বায়ুকে উত্তর – পশ্চিম আয়ন বায়ু বলে।

মেরু বায়ুঃ

মেরুবৃত্তীয় উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে মেরুপ্রদেশীয় নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে সারাবছর ধরে নিয়মিতভাবে এবং নির্দিষ্ট পথে যে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাকে মেরু বায়ু বলে।

       দুই মেরু সংলগ্ন অঞ্চলে অধিক শৈত্যের জন্য বায়ু সবসময় শীতল ও ভারী হয়। পাশাপাশি সূর্যকিরণের অভাবে এখানকার বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম হয়। তাই এখানে স্থায়ী উচ্চচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

অন্যদিকে পৃথিবীর আবর্তন বেগ মেরুদ্বয়ের তুলনায় মেরুবৃত্ত প্রদেশে [60o – 65o অক্ষাংশ) খুব বেশি হয়। ফলে এখানকার বায়ু ক্রান্তীয় অঞ্চলের দিকে বিক্ষিপ্ত হয় ও বায়ুর চাপ হ্রাস পায়। ফলে এখানে একটি স্থায়ী নিম্নচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়। মেরুবৃত্তীয় উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে মেরুপ্রদেশীয় নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে সারাবছর ধরে এক ধরনের বায়ু ধারাবাহিকভাবে প্রবাহিত হয়। একেই মেরু বায়ু বলে।

ফেরেলের সূত্র অনুসারে উত্তর গোলার্ধে উত্তর – পূর্ব দিক থেকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে এই বায়ু প্রবাহিত হয়।

উত্তর গোলার্ধের মেরু বায়ুকে উত্তর – পূর্ব মেরু বায়ু এবং দক্ষিণ গোলার্ধের মেরুবায়ুকে দক্ষিণ – পূর্ব মেরু বায়ু বলে।




Previous
Next Post »