মাধ্যমিক বাংলা প্রবন্ধ: হারিয়ে যাওয়া কালি কলম রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর



মাধ্যমিক বাংলা
প্রবন্ধ: হারিয়ে যাওয়া কালি কলম 
রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর 
প্রতিটি প্রশ্নের মান ৫
১. ‘কারো হাতে কলম নেই'–প্রসঙ্গ উল্লেখ করে কলম না থাকার কারণ ব্যাখ্যা করো।
উঃ 
“হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ - প্রবন্ধটি ‘শ্রীপান্থ’ ছদ্মনামে নিখিল সরকারের লেখা।
লেখক সংবাদপত্র অফিসে কাজ করতেন, নানা  বিষয়ে লেখালেখির সৃষ্টি সেখানে হয়।  বর্তমানে সেখানে কলমের ব্যবহার নেই, সকলেই কম্পিউটারের সাহায্যে অনবরত লিখে যান। কি-বোর্ডে ছাপানো লেখাগুলোতে চাপ দিলেই সামনে থাকা চৌকো আয়নার মতো স্ক্রিনে সেই লেখাগুলো ফুটে ওঠে। লেখাগুলো সঠিক হচ্ছে কিনা দেখার জন্য মাঝেমাঝেই স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখতে হয়। এই কাজে কলমের কোনো দরকার হয় না। 
সভ্যতার অগ্রগতিতে কলমের জায়গা কম্পিউটার নিয়েছে তাই লেখক এই উক্তি করেছেন।
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘কালি নেই, কলম নেই, বলে আমি মুনশি’। ‘মুনশি’ অর্থাৎ লেখক হতে গেলেও এখন আর কলমের দরকার হয় না, কম্পিউটার সরাসরি ছাপার জন্যই লেখাকে প্রস্তুত করে দেয়। সুতরাং দুবার খাটতে কে আর কলমে লিখতে যাবেন! কলমের প্রয়োজন নেই, তাই সেখানে কলমও নেই। 

২. ‘কালি কলম মন, লেখে তিন জন।'—কালি কলম প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে লেখকের কোন্ বাল্যস্মৃতি মনে পড়ে গিয়েছে?
উঃ 
‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’-এর লেখক নিখিল সরকার বাংলাদেশের এক অজ পাড়াগাঁয়ে জন্মেছেন এবং সেখানেই হয়েছে তাঁর বাল্যশিক্ষা। রোগা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তখন তাঁরা কলম তৈরি করতেন। বড়োরা শিখিয়ে দিয়েছিল শুধু সুঁচালো হলেই চলবে না, মাথাটা চেরা হলে ধীরে ধীরে চুইয়ে পাতায় কালি পড়বে। লেখকেরা তখন কলার পাতাতেই হোম-টাস্ক করে তা বান্ডিল করে স্কুলে নিয়ে যেতেন। শিক্ষকমহাশয় দেখার পর তা ছিঁড়ে দিতেন।
সেই কলার পাতা স্কুল থেকে ফেরার পথে তাঁরা কোনো পুকুরে ফেলে আসতেন, কেননা অক্ষর গোরুতে খেলে নাকি ঘোর অমঙ্গল হয়। 
আবার কালিও তাঁরা নিজেরাই তৈরি করতেন। মা-পিসিরা ব্যবস্থাপত্র অনুসারে উৎকৃষ্ট মানের কালি তৈরি করতেন। লেখক ও তাঁর সহপাঠীরা তৈরি করতেন কাজ চলা গোছের কালি। কড়াইয়ের তলার কালি লাউপাতা দিয়ে ঘষে তুলে পাথরের বাটিতে গুলে তাতে হরীতকী ঘষে দিতেন, আবার কেউ কেউ আতপ চাল পুড়িয়ে বেঁটে তাতে মেশাত। সব ভালো করে মেশানোর পর খুক্তির গোড়ার দিক পুড়িয়ে টকটকে লাল করে সেই জলে ছেঁকা দেওয়া হত। অল্প জল বলে তা অনেক সময় টগবগ করে ফুটত। তারপর সেই কালি ছেঁকে মাটির দোয়াতে ভরে রাখা হতো।
কলমের প্রসঙ্গ ওঠায় লেখকের এই কথাগুলো মনে পড়ে গিয়েছে।

৩. ‘আমরা কালিও তৈরি করতাম নিজেরাই।' আমরা কারা? তাঁরা কীভাবে কালি তৈরি করতেন?
উঃ 
‘আমরা’ বলতে হারিয়ে যাওয়া কালি কলমের লেখক শ্রীপান্থ অর্থাৎ নিখিল সরকার নিজে এবং তাঁর সমবয়সিদের কথা বলেছেন।
মা-পিসিদের সাহায্যে ছোটোরা কালি তৈরি করত বাড়িতেই। তবে সেটা প্রাচীন শাস্ত্রের নিয়ম মেনে নয় : “তিল ত্রিফলা সিমুল ছালা/ছাগ দুগ্ধে করি মেলা/লৌহপাত্রে লোহায় ঘসি/ছিড়ে পত্র না ছাড়ে মসি।” এই ছিল কালি তৈরির আদর্শ উপায়। 
তবে সবাই আর অতসব উপকরণ পাবেন কোথায়? সহজ পদ্ধতি ও উপকরণেই কাজ করতে হতো। কাঠের আগুনে যে কড়াই চাপত তার নীচে কালি পড়ত। লাউপাতা দিয়ে ঘষে ঘষে তা তুলে একটা পাথরের বাটিতে জল ঢেলে তা গুলিয়ে নিতে হতো। যারা নিপুণ তারা আবার ওই কালো জলে হরীতকী ঘষত। আতপ চাল ভেজে পুড়িয়ে তা আবার বেটে মেশানো হতো। সব মিশে যাবার পর একটা খুক্তির গোড়ার দিকটা পুড়িয়ে লাল করে নিয়ে সেই জলে ছ্যাঁকা দেওয়া হতো। অল্প জল বলে টগবগ করে ফুটত। শেষে ন্যাকড়ায় ছেঁকে তা দোয়াতে ভরলেই হল! কালি তৈরি হয়ে গেল।
তারপর তো এলো কালির ট্যাবলেট বা বড়ি—লাল, নীল। তা ছাড়া দোয়াতে না ঢেলেই কাচের শিশিতে এলো কালি—তা থেকে কলমে ভরে নিয়েই লেখা।

৪. 'আমার মনে পড়ে ফাউন্টেন পেনের কথা।' ফাউন্টেন পেন কী? এ প্রসঙ্গে লেখকের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দাও।
উঃ 
‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে লেখক নিখিল সরকার ফাউন্টেন পেন সম্বন্ধে বলেছেন লুইস অ্যাডসন ওয়াটারম্যান উদ্ভাবিত বিশেষ কলমের কথা যার থেকে ঝরনার জলের মতো কালি নি:সৃত হয়।
এই প্রসঙ্গেই লেখকের মনে পড়ে জীবনের প্রথম ফাউন্টেন পেন কেনার অভিজ্ঞতার কথা। ঘটনাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেশ কয়েক বছর পরের কথা। কলেজস্ট্রিটের এক নামী দোকানে লেখক কলম কিনতে গিয়েছেন। দোকানি তাঁর পছন্দের ফাউন্টেন পেনের নাম জানতে চাইলে এবং লেখককে চুপ করে থাকতে দেখে দোকানি আউড়ে গেলেন পার্কার, শেফার্ড, ওয়াটারম্যান, সোয়ান, পাইলট ইত্যাদি কলমের নাম। তার মধ্যে লেখক পার্কারের নামটিই বলেননি। 
দোকানি লেখকের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর পকেটের অবস্থা বুঝে একটি জাপানি পাইলট পেন তাঁকে দেখান। এ ছাড়াও তিনি জানান কলমটি সস্তার হলে কী হবে গুণমানে সেটি বেশ দামি। মুখ থেকে খাপটা খুলে তিনি টেবিলের পাশে দাঁড় করানো কাঠের বোর্ডের দিকে কলমটি ছুঁড়ে মারলেন। তারপর নিব সমেত কলমটি সেখান থেকে এনে লেখককে দেখালেন তার কোথাও কোনো বিকৃতি ঘটেনি। লিখেও দেখালেন। হয়তো বা নিবটা বেঁকে বা ভেঙেও যেতে পারত কিন্তু কিছুই হল না। সেই জাদু পাইলটটাই লেখক কিনলেন এবং বহু বছর সেটি ব্যবহার করেছেন। 
প্রবন্ধে লেখকের এই ফাউন্টেন পেন কেনার অভিজ্ঞতার কথা তাঁর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

৫. ‘দোয়াত যে কত রকমের হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত।'—কোন্ প্রসঙ্গে কথাটি বলা হয়েছে? বিভিন্ন প্রকার দোয়াতের যে বর্ণনা লেখক দিয়েছেন তা তোমার নিজের ভাষায় লেখো।
উঃ 
‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে লেখক নিখিল সরকার শৈশবে স্কুলজীবনের প্রথমে কলমের কথা বলতে গিয়ে দোয়াতের কথাও বলেছেন।বর্তমানে দোয়াতের ব্যবহার শিক্ষিত ঘরে বা অফিস-আদালতে আর দেখা যায় না, সেগুলো এখন শুধু ঘরে সাজিয়ে রাখা হয়। এই প্রসঙ্গেই লেখক উক্তিটি করেন।
দোয়াতের বর্ণনা প্রসঙ্গে লেখক কাঁচ, কাট-গ্লাস, পোর্সেলিন, শ্বেতপাথর, জেড পাথর, পিতল, ব্রোঞ্জ, ভেডার সিং, সোনা ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদান দিয়ে তৈরি দোয়াতের কথা বলেছেন। গ্রামে কেউ দু-একটা পাশ দিলেই গুরুজনরা সোনার দোয়াত কলম হোক বলে আশীর্বাদ করতেন। সোনার দোয়াত কলম লেখক দেখেছিলেন শুভো ঠাকুররের সংগ্রহ দেখতে গিয়ে। সাহিত্য, ইতিহাস, মহাকাব্য থেকে শুরু করে নানা প্রসঙ্গ সেখানে খোদাই করা ছিল। 
এই আধুনিক যুগে অফিসের টেবিল সাজাতে দোয়াতদানের ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায়। তবে সে কেবলই চোখকে ফাঁকি দেবার কারসাজি। কেননা তাতে থাকে ডট বা বল পেন। দোয়াতে কালি থাকত। আর সেইসব যুগে শেক্সপিয়র, দান্তে, মিল্টন, কালিদাস, ভবভূতি, কাশীরাম দাস, কৃত্তিবাস ওঝা, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র অবিস্মরণীয় সৃষ্টি করে গেছেন। আগেকার দিনে ব্যবসায়ী, উকিল, বুদ্ধিজীবীরা লেখালেখির কাজটা সহজ করে তোলার জন্যে সঙ্গে দোয়াত কলম রাখতেন। সইসাবুদ, চুক্তিপত্র ইত্যাদি কাজে দোয়াত দান ও তাতে সংরক্ষিত কালির ওপর ভরসা করতেন।
Previous
Next Post »