নদীর কার্য



উচ্চগতিতে নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ

উত্তরঃ
পার্বত্য অঞ্চলের তরঙ্গায়িত খাড়া ঢাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসা খরস্রোতা নদী জলস্রোতের আঘাত, অবক্ষয় ইত্যাদি ক্ষয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপত্যকার ভাস্কর্য ঘটিয়ে নিম্নলিখিত ভূমিরূপ সৃষ্টি করে। 

ক) V আকৃতি উপত্যকাঃ

উচ্চ প্রবাহে নদী খাড়া ঢাল বরাবর প্রবাহিত হয়ে আসার সময় জলধারায় বাহিত শিলাখন্ডগুলির অবঘর্ষ প্রক্রিয়ায় নদীখাতের প্রবল নিম্নক্ষয় ঘটায় ও নদীখাত গভীর, সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। তবে বৃষ্টিপাত,  আবহবিকার ইত্যাদি কারণে উপত্যকার উধ্বাংশ ধ্বসে গিয়ে কিছুটা প্রশস্থহলে নদীখাতের আকৃতি আড়াআড়িভাবে ইংরাজি V অক্ষরের মতাে দেখতে হয় বলে একে V আকৃতির উপত্যকা বলে।
আর্দ্র অঞ্চলের অধিক নিম্নক্ষয়ের কারণে সুগভীর, সংকীর্ণ ও খাড়া ঢালযুক্ত ‘V আকৃতির উপত্যকা 'গিরিখাত" বা GORGE নামে পরিচিত। 
উদাহরণ : দক্ষিণ আমেরিকার কলকা নদীর গিরিখাত, নেপালের কালী নদীর গিরিখাত ইত্যাদি। 

খ) ক্যানিয়নঃ

অতি শুষ্ক বৃষ্টিহীন পার্বত্য অঞ্চলে নদী যখন কোমল শিলাস্তরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন সেখানে একদিকে বৃষ্টিপাতের অভাবে নদী উপত্যকার দুপাশে ভূমিক্ষয় যেমন কম হয়, তেমনই অন্যদিকে কোমল শিলাস্তরের জন্য নদী নিম্নক্ষয় বেশি করে। এর ফলে নদীখাত অত্যন্ত গভীর সংকীর্ণ ও খাড়াঢাল যুক্ত এবং আড়াআড়িভাবে দেখতে ইংরাজি অক্ষর ‘I’ র মতাে হয়। শুষ্ক অঞ্চলের সংকীর্ণ, গভীর, খাড়াটালযুক্ত ও সুদীর্ঘ I আকৃতির উপত্যকাকে ক্যানিয়ন বলে।
উদাহরণ : আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দ. প. র মরু অঞ্চলে কলরাডাে নদীর Grand Canion পৃথিবীর বৃহত্তম ক্যানিয়ন।

গ) মন্থকূপঃ

পার্বত্য অঞ্চলে প্রবল গতিবেগে প্রবাহিত নদীর জলধারার সাথে বাহিত নুড়ি, শিলাখন্ডগুলি ঘূর্ণায়মান অবস্থায় নদীখাতের তলদেশের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে অগ্রসর হলে নদীখাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গােলাকার গর্তের সৃষ্টি হয়। প্রবল
জলস্রোতের কারণে শিলাখন্ডগুলি গর্তের মধ্যে প্রবেশ করে জলাবর্তের প্রভাবে গর্তের দওেয়ালকে অনবরত ক্ষয় করে এবং গর্তটি আকারে বড় হয়ে যায়। তবে গর্তের মুখটি অপেক্ষাকৃত ছােটো হওয়ায় গর্তটি দেখতে হাঁড়ি বা বর্তুলাকার হয়। এই বিশেষ আকৃতির গর্তকে মন্থকূপ বলে।
উদাহরণঃ ঝাড়খন্ডের সরাই কেল্লার কাছে ঘরকাই নদীগর্ভে মন্থকূপ সৃষ্টি হয়েছে।

ঘ) জলপ্রপাতঃ 

পার্বত্য অঞ্চলে কঠিন ও কোমল শিলাস্তর পরপর থাকলে নদী যখন কঠিন থেকে কোমল শিলাস্তরে উপনীত হয়, তখন কোমল শিলা দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে খাড়া ঢালের সৃষ্টি করে। এই খাড়াটলের ওপর থেকে জলধারা হঠাৎ নীচে পতিত হলে, তাকে জলপ্রপাত বলে।
উদাহরণঃ
উত্তর আমেরিকার সেন্টল রেন্স নদীর উপর নায়াগ্রা জলপ্রপাত।
এ ছাড়া জলপ্রপাত সৃষ্টি হতে পারে –
(i) নদীর গতিপথে চ্যুতি থাকলে – জাম্বেসি নদীর ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত।
(ii) মালভূমির খাড়া প্রান্তদেশ দিয়ে নদী প্রবাহিত হলে -  সরাবতী নদীর যােগ জলপ্রপাত।
(iii) ঝুলন্ত উপত্যকা দিয়ে নদী প্রবাহিত হলে - উত্তর আমেরিকার ইয়ােসেমিতি জলপ্রপাত।
(iv) ভূ-আন্দোলনজনিত নদীখাতের উত্থান বা অবলম্বন ঘটে নিক পয়েন্ট সৃষ্টি হলে – সূবর্ণরেখার হুড্রু 

ঙ) শৃঙ্খলিত শৈলশিরার অভিক্ষিপ্তাংশঃ  

পার্বত্য অঞ্চলের অনেকসময় নদীখাতের উভয় পাশ্ববর্তী কঠিন শিলার শৈলশিরাগুলি নদীর গতিপথে বাধা সৃষ্টি হলে, নদীগুলিকে বাধা এড়িয়ে আঁকাবাঁকা পথে প্রবাহিত হতে হয়। এ কারণে শৈলশিরার অভিক্ষিপ্তাংশগুলি পর্যায়ক্রমে বিস্তৃত থেকে পরস্পরকে এমনভাবে অতিক্রম করে যে দূর থেকে দেখলে মনে হয়, সেগুলি শৃঙ্খলের ন্যায় আবদ্ধ রয়েছে এবং নদীর গতিপথ উৎসের দিকে আড়াল হয়ে গেছে। একে শৃঙ্খলিত বা আবদ্ধ শৃঙ্খলিত শৈলসিরা বা কুম্ভীর দন্তবিন্যাসী শৈলশিরা বলে।
উদাহরণঃ গঙ্গা, কোশী, গণ্ডক প্রভৃতির উচ্চপ্রবাহে দেখা যায়।
তাছাড়া উচ্চগতিতে নদীর ক্ষয়কাজের ফলে জলপ্রপাতের নীচে প্রপাতকূপ, খরস্রোত, কর্তিত শৈলশিলার অভিক্ষিপ্তাংশ প্রভৃতে ভূমিরূপ দেখা যায়।
নদীর সঞ্চয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ 
1. পলল শঙ্কু ও পলল ব্যজনীঃ 
পলল শঙ্কুঃ
পার্বত্য অঞ্চল পেরিয়ে নদী যখন সমভূমিতে নেমে আসে তখন ভূমির ঢাল হঠাৎ হ্রাস পায় এবং নদীর বেগ কমে যায়। ফলে, নদীর বহন ক্ষমতা ও স্রোতের বেগ উভয়েই হ্রাস পায়। এই অবস্থায় নদী উপত্যকায় পলি, কাঁকর, নুড়ি সঞ্চিত হয়ে শঙ্কু আকৃতির যে ভূমিরূপ গড়ে ওঠে, তাকে পলল শঙ্কু বলে।
পলল ব্যজনীঃ
সমভূমিতে নদী এই পলল শঙ্কুর উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে পলল শঙ্কুটি অর্ধগোলাকার আকৃতি ধারণ করে এবং এটি অনেকটা হাতপাখার মতো দেখতে হয়। অর্ধগোলকাকার এই
ধরনের ভূমিরূপকে পললব্যজনী বলে।
উদাহরণঃ 
শিবালিকের দক্ষিণ ঢালে অনেক পলল শঙ্কু ও পলল ব্যজনী দেখা যায়।
2. নদী বাঁক বা মিনেন্ডারঃ 
মধ্য ও নিম্নপ্রবাহে নদীর গতিবেগ কম থাকায় সামান্য বাধার সম্মুখীন হলে নদী তার গতিপথের পরিবর্তন ঘটায় এবং এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়। একে নদী বাঁক বলে। 
তুরস্কের আঁকাবাঁকা নদী মিয়েন্ডারেস-এর নাম অনুসারে এই ভূমিরূপের নাম হয়েছে মিয়েন্ডার। 
সমভূমি অঞ্চলে নদীর গতিপথে পলল অবক্ষেপণের ফলে
নদীর গতি ধীর হয়ে যায় এবং নদীপথ বেঁকে যায় । নদীর বেঁকে যাওয়া অংশে অতিরিক্ত ক্ষয়ের ফলে খাড়া পাড়ের সৃষ্টি হয়। খাড়া পাড়ের বিপরীত দিকে নদী স্রোতের বেগ কম থাকায় সঞ্চয়কার্য ঘটতে থাকে। ফলে সেখানে ঢালু পাড়ের সৃষ্টি হয়। 
উদাহরণঃ
গঙ্গা নদীতে এবং নদিয়া জেলার জলঙ্গী নদীতে অসংখ্য নদী বাঁক দেখা যায়। 
3. অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদঃ
অসংখ্য বাঁকবিশিষ্ট নদীতে পার্শ্বক্ষয়ের ফলে নদীর বাঁক এত বেশি বৃদ্ধি পায় যে অনেক সময় দু'টি বাঁক খুব কাছাকাছি এসে পড়ে। এরূপ ক্ষেত্রে ঐ বাঁক দুটির মধ্যবর্তী অংশ ক্ষয় পেলে বাঁক দুটি জুড়ে যায় ও নদী সোজা পথে বয়ে চলে। ক্ষয়প্রাপ্ত বাঁকা অংশটি তখন নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হ্রদের আকার ধারণ করে। এরূপ হ্রদ অনেকটা ঘোড়া বা গরুর ক্ষুরের মত দেখতে হয় বলে একে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ বা গো-ক্ষুর হ্রদ বলে। 
মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গার দুপাশে এরূপ বহু অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ দেখা যায়। উত্তরপ্রদেশে ও বিহারে এরূপ হ্রদগুলিকে কোর বা তাল বলে।
4. প্লাবনভূমি ও স্বাভাবিক বাঁধঃ 
নদী তার নিম্নগতিতে সমুদ্রের কাছাকাছি চলে এলে নদীর ভূমির ঢাল হ্রাস পায় এবং নদী বাহিত শিলাখণ্ড, নুড়ি, বালি প্রভৃতি নদীগর্ভে সঞ্চিত হয়। এর ফলে নদীর গভীরতা হ্রাস পায়। বর্ষাকালে নদীতে হঠাৎ জল বেড়ে গেলে এই অগভীর নদী উপত্যকা জল বহন করতে পারে না। বন্যার জল দুই কূল প্লাবিত করে প্লাবন ভূমির সৃষ্টি করে। নদীর দুই তীরে ধীরে ধীরে পলি, বালি, কাদা সঞ্চিত হয়ে ধীরে ধীরে উচুঁ হয়ে
বাঁধের সৃষ্টি হয়। এই বাঁধ প্রাকৃতিক উপায়ে গঠিত হয় বলে একে স্বাভাবিক বাঁধ বলে। 
উদাহরণঃ সিন্ধু গঙ্গা প্রভৃতি নদীর অববাহিকায় এই ধরনের ভূমিরূপ দেখা যায়। 
5. ব-দ্বীপঃ 
মোহনার কাছে ভূমির ঢাল প্রায় সমুদ্র সমতলে অবস্থান করে। এই সময় নদীবাহিত পলি, বালু, নুড়ি, কাঁকড় ইত্যাদি সমুদ্রের লবণাক্ত জলের সংস্পর্শে এসে দ্রুত থিতিয়ে পড়ে। ফলে মোহনার কাছে সমুদ্র ক্রমশ অগভীর হয়ে নতুন ভূমিরূপ গঠন করে। এই ধরনের ভূমিরূপ দেখতে অনেকটা মাত্রাহীন ‘ব’ বা গ্রীক অক্ষর ডেল্টা - র মত হয় বলে এদের ব-দ্বীপ (Delta) বলা হয়। ব-দ্বীপের কাছে নদী বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে এবং বিস্তৃত ব-দ্বীপ সমভূমির সৃষ্টি করে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর মিলিত ব-দ্বীপ পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম এবং সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ সমভূমি।
ব-দ্বীপকে সাধারণত তিনভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। 
[ক] ত্রিকোণ-আকৃতির ব-দ্বীপঃ
উপনদী যেখানে মূল নদীর সঙ্গে এসে মিলিত হয়, সেখানে এই প্রকার ব-দ্বীপের সৃষ্টি হয়। দামোদর ও হুগলী নদীর মিলনস্থলে এই প্রকার ব-দ্বীপ দেখা যায়। 
[খ] হ্রদ ব-দ্বীপঃ
বিশাল হ্রদের ওপর যে ব-দ্বীপ গড়ে ওঠে, তাকে হ্রদ ব-দ্বীপ বলে। ভল্গা নদী কাস্পিয়ান সাগরে এরূপ ব-দ্বীপের সৃষ্টি করেছে। 
[গ] সমুদ্র ব-দ্বীপঃ 
সমুদ্রের ওপর যে ব-দ্বীপ সৃষ্টি হয় তাকে সমুদ্র ব-দ্বীপ বলে। যেমন—সুন্দরবন ব-দ্বীপ । পৃথিবীর অধিকাংশ বদ্বীপই দেখতে গ্রীক অক্ষর ডেলটা-র মত। কিছু কিছু ব-দ্বীপ সমুদ্রস্রোতের প্রভাবে বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মিসিসিপি -মিসৌরী নদীর ব-দ্বীপ পাখির পায়ের মত দেখতে। ভারতে কৃষ্ণা নদীর ব-দ্বীপ অনেকটা পাখির পায়ের মত।
6. খাঁড়িঃ
সমুদ্রের নিকট নদী মোহনায় জোয়ার-ভাঁটা হয়। জোয়ারের জল নদীখাতে ঢুকে নদী উপত্যকাকে আরও চওড়া করে দেয়। একে খাঁড়ি বলে। পশ্চিমবঙ্গে সুন্দরবন অঞ্চলে এরূপ
অসংখ্য খাঁড়ি দেখা যায়। রাশিয়ার উত্তরে ওব নদীর মোহনায় অবস্থিত খাঁড়িটি পৃথিবীর দীর্ঘতম খাঁড়ি।










Previous
Next Post »